আবুল কাসেম ফজলুল হক: রাষ্ট্র চিন্তা।
সুমন দেব নাথ
এক.
আবুল কাশেম ফজলুল হক: শুভবুদ্ধি ও কল্যাণ চিন্তার লেখক। গবেষক, লেখক, ঐতিহাসিক, অনুবাদক, সমাজ ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও তত্ত্ব দ্রষ্টতা রূপে তিনি সুখ্যাত হলেও সহ¯্র সংকট ভারাক্রান্ত বাংলাদেশের একজন শুভবুদ্ধি ও কল্যাণ চিন্তার লেখক হিসেবেই অনেকে তাঁকে মূল্যায়ন করেন। প্রগতির চেতনা ও সময়ের সঠিক চিন্তাকে ধারণ করতে তিনি সর্বদাই ঋদ্ধ।
এই প্রথিতযশা কল্যাণ শিল্পীর জন্ম ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪; পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ। তাঁর পিতা মুহাম্মদ আবদুল হাকিম, মাতা জাহানারা খাতুন এবং তাঁর সহধর্মিনী ফরিদা প্রধান। তিনি এক পুত্র ও এক কন্যার জনক। তাঁর কন্যা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ---বিভাগে –অধ্যাপক পদে কর্মরত রয়েছেন এবং তাঁর পুত্র ফয়সাল আরেফিন দীপন বহুখ্যাত ‘জাগৃতি প্রকাশন’-এর প্রকাশক রূপে কর্মরত ছিলেন। ৩১ অক্টোবর, ২০১৫ খ্রি. কতিপয় দুর্বৃত্ত কর্তৃক তিনি নিহত হন।
আবুল কাশেম ফজলুল হক ১৯৫৯ খ্রি. ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আনন্দমোহন কলেজ থেকে ১৯৬১ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৬৫ সালে ¯œাতক (সম্মান) এবং ১৯৬৬ সালে ¯œাতকোত্তর কৃতিত্ত্বের সঙ্গে পাস করেন। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আজীবন অধ্যাপনা করে ২০১১ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের আর একজন মুক্ত চিন্তক ড. আহমদ শরীফ কল্যাণ চিন্তা ও মুক্ত চিন্তাকে বিকশিত করার জন্য --সালে গড়েছিলেন ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘ’ নামক একটি মুক্তচিন্তক প্রতিষ্ঠান। আবুল কাশেম ফজলুল হক ---সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন এবং তাঁর সম্পাদনায় ‘লোকায়ত’ পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে।
‘স্বদেশ চিন্তা সংঘ’ আবুল কাশেম ফজলুল হকের নেতৃত্বে ২০০৫ সাল থেকে ‘আটাশ দফা’ কর্মসূচি নিয়ে জনগণের সঙ্গে সমাজ পরিবর্তনের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। অকৃত্রিম দেশপ্রেম ও গঠনমূলক স্বদেশ চিন্তার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: বাংলাদেশ লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৪), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০০৬)। ১
লেখকের সম্পাদিত ও লিখিত পুস্তকসমূহ হল: কালের যাত্রা ধ্বনি, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও উত্তরকাল, উনিশ শতকের মধ্যশ্রেণি ও বাংলা সাহিত্য, মুক্তি সংগ্রাম, সাহিত্য চিন্তা, নবযুগের প্রত্যাশায়, যুগ সংক্রান্তি ও নীতি জিজ্ঞাসা, নৈতিকতা: শ্রেয়োনীতি ও দুর্নীতি, আধুনিকতাবাদ ও জীবনানন্দের জীবনোৎকণ্ঠা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য, মাও সেতুঙের জ্ঞানতত্ত্ব, মানুষ ও তার পরিবেশ, রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কোন পথে, সংস্কৃতির সহজ কথা, অবক্ষয় ও উত্তরণ, রাজনীতি ও দর্শন, প্রাচুর্যে রিক্ততা, বিশ^ায়ন ও সভ্যতার ভবিষ্যত, রাজনীতি ও সংস্কৃতি: সম্ভাবনার নব দিগন্ত, তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রথম বাংলাদেশ সরকার, বার্ট্রান্ড রাসেল: রাজনৈতিক আদর্শ (অনুবাদ), বাংলাদেশের রাজনীতিতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার। এই তালিকা পূর্ণ নয়, এই সমস্ত পুস্তক ব্যতীতও দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মতামত, সাক্ষাতকার প্রভৃতি সৃষ্টিশীল কর্ম ছড়িয়ে রয়েছে।
চিন্তাবিদ আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রথম জীবনে স্বল্প কবিতা ও কথা সাহিত্য রচনা করলেও শীঘ্রই তিনি তাঁর প্রতিভার ক্ষেত্রটি উপলব্ধি করেন এবং চিন্তা ও গবেষণামূলক কর্মে নিবিষ্ট হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তাঁর রাজনৈতিক চেতনাকে সক্রিয় করেছে। ’৬০ এর দশকের প্রগতিশীল চেতনা দ্বারা তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত, সুদীর্ঘ ছয় দশক ধরে তিনি বাংলাদেশের জনমনে দেশপ্রেম ও নৈতিকতার চেতনা জাগ্রত করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সর্বদাই বলে এসেছেন যে নৈতিকতার শিক্ষা ব্যতীত যে কোন আদর্শই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হচ্ছেও তাই; এজন্য পরিবারে, পাঠ্যপুস্তকে, রাজনৈতিক দলে, বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠনে প্রয়োজন নীতিবোধের চর্চা।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে কার্যকর গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে একটি জনকল্যাণমুখি রাষ্ট্র গঠিত হবে -এই ছিল লেখকের প্রত্যাশা। তিনি আকাক্সক্ষা করেন রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের শুভবুদ্ধি কোন এক সময় জাগ্রত হবে, বিশেষত তরুণ সমাজকে অতীতের ভ্রান্তি সম্পর্কে সচেতন করে দেশের কল্যাণে নিযুক্ত করাই তাঁর লেখনির উদ্দেশ্য। জ্ঞানীগণ ইতিহাস অধ্যয়ন করতে বলেন কেননা সেখানেই সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। ইতিহাস আমাদের শুভ ও অশুভ লক্ষণগুলোকে চিনতে শিক্ষা দেয়। আবুল কাশেম ফজলুল হক সর্বদা ইতিহাসের সাধনায় ব্যাপৃত আছেন, দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে তিনি যেসব ভবিষ্যতবাণী করেছেন তাঁর দু একটি অপ্রধান ক্ষেত্র ব্যতীত সবই আমরা ঘটতে দেখেছি।
দুই.
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগকে লেখক কখনই সমর্থন করেননি, এটা ছিল বিগত দিনের ভুল রাজনীতির এক অনিবার্য কর্মফল,“ কর্মফল সম্পর্কে সচেতনতা জাগলে, অন্য সময়ে যাই হোক, অন্তত ‘মুজিবনগর’ (কোলকাতা) থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের ও বুদ্ধিজীবীদের কলহ-কোন্দলের ও অবিমৃষ্যকারী কার্যকলাপের সংবাদ শোনা যেত না। ছয় দফা আন্দোলনের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত কালে যে কর্মফল তৈরি করেছি, স্বাধীন বাংলাদেশে তাই আজ আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে।” ২
দীর্ঘদিনের শাসন -নিষ্পেষণের পরে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হল, বাঙালিরা ভেবেছিল এবার তারা উপদ্রব মুক্ত হয়েছে কিন্তু বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই পূর্ব বাংলার জনগণকে আর একটি ক্রান্তিকালে প্রবেশ করতে হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্না উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করেন। বাংলা ভাষা এবং বাঙালী সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বাংলার ওপর সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়, যে দি¦জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল পুনরায় রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার ফিরিয়ে আনা হল, ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সাল থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৮-এর কৃষক ছাত্র আন্দোলন, পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের মধ্যে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রণ্টের বিজয় ও মুসলিম লীগের পরাজয়, ১৯৫৭ সালের কাগমারি সম্মেলন, ১৯৫৮ সালে আয়ুব সরকারের সামরিক শাসন, ১৯৬২-’৬৪ সালে ছাত্র আন্দোলন ও সেনা বিরোধী গণআন্দোলন, ’৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন, ’৬৫ সালে শ্রমিক আন্দোলন, ’৬৬ সালে ৬-দফা আন্দোলন জনগণকে জাতীয়তাবাদের উত্থান, ১৯৬৯ –এর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগার দফা উল্লেখযোগ্য, এর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার নিজস্ব রূপ পায় যার ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ইয়াহিয়া খানের পরাজয় ও তার জনসমর্থনহীনতা সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের বর্বরোচিত হামলা মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে।
স্বাধীনতা পরবর্তী ঘটনা প্রবাহও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের কর্মে যখন সব শ্রেণির মানুষের সচেষ্ট হওয়ার কথা তখন স্বার্থান্বেষীরা জাতীয়তাবাদের আড়ালে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে থাকে এর সুযোগ নিয়ে পরাজিত মৌলবাদী ও পাকিস্তানী দোসরেরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পুনস্থাপনে তৎপর হতে থাকে। সেই সাথে বাম-ডান-সাম্প্রদায়িক-মস্কো-পিকিং-মার্কিন পন্থী-সামরিক হস্তক্ষেপ সেই সঙ্গে আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা বিধি সংকটে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং জাতীয়তাবাদ বা গণতন্ত্র বা বাম ধারা কোনটিই দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে না পারার কারণে নব গঠিত বাংলাদেশের ভবিষ্যত অন্ধকারে তলিয়ে যায়।
আবুল কাশেম ফজলুল হক স্বাধীনতা পরবর্তী ঘটনাবলী সম্পর্কে বলেন,“যুদ্ধ শেষে স্বজন -হারানো-শ্মশানে রিক্ত আমরা-নিঃস্ব আমরা-নতুন নামে রাষ্ট্র পেলাম, অপূর্ব জনপ্রিয় নেতা তৈরি করলাম, নতুন রাষ্ট্রীয় আদর্শের ঘোষণা শুনলাম। কিন্তু যুগান্তরসম্ভব ঘটনারাজি, লাখো মানুষের প্রাণহানি, আর সম্পদ ধ্বংসের পর যে মহান বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও নবযুগ অভিপ্রেত ছিল, তার কোন লক্ষণই দেখা গেল না। বছর না ঘুরতেই মনে হল: যারা মরেছে, বৃথা মরেছে; আর যারা বেঁচে আছি, বৃথা বেঁচে আছি; জীবনের অর্থ আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হইনি আমরা। নবপর্যায়ে পৈশাচিক তা-বে আমাদের ওপর আরম্ভ হল বিজয়দম্ভীদের স্বেচ্ছাচার। সব রকম রীতি-নীতি,আইন-কানুন, প্রথা পদ্ধতি ভেঙে ফেলা হল-গড়ে তোলা হল না কিছুই। রক্ষক পরিণত হল ভক্ষকে। শাসক পরিণত হল নৈতিক -চেতনা-বিবর্জিত, লোভ-লালসার দাস, সঙ্কীর্ণচিত্ত, মমতাহীন, করুণাহীন স্বেচ্ছাচারীতে। নৈতিক উপলব্ধিকে, নীতিবোধকে, ভালো-মন্দ উচিত -অনুচিত প্রশ্নকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উদ্যোগ চলতে থাকল। উন্মত্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়ে এই হার্মাদদের স্বেচ্ছাচার –স্বৈরাচার, অত্যাচার-অবিচার, শোষণ, পীড়ন-প্রতারণা, খুন-খারাপি, লুঠ-তরাজ ও চুরি-ডাকাতি কি কম ছিল? জাতির কী নির্মম পরিণতি!” ৩
আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এই দুষ্টচক্র থেকে কেউই বের হতে চায় না কিন্তু এই ঝঞ্ঝাকে অতিক্রম না করলে মুক্তি নেই সেটিও সত্য, বর্তমানের অবস্থাদৃষ্টে এটাই মনে হয় যে, কেউই চায় না এর অবসান হোক। এত প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে যে স্বাধীনতা তাকে সফল পরিণতি দেওয়া হোক। লেখক হয়তো কোন দিন স্বপ্নেও ভাবেননি এই অপরাজনীতি তাঁর পুত্রের প্রাণ নিয়ে নেবে। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন,“ বিচার চেয়ে কী হবে? এদেশে রাজনৈতিক সমাধান যতক্ষণ পর্যন্ত না হচ্ছে আমরা শূন্যের মধ্যে ভালো কিছু খুঁজছি। এটা পাওয়া সম্ভব নয়। আমার কাছে মনে হয়, আগে এটা আদর্শগত ও রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা বামপন্থী-কেউই কি এখনকার পরিস্থিতি থেকে বের হতে চায়? আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ চেয়েছিলাম, সেটিও পেয়েছি। কিন্তু এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করে যে গণতন্ত্র আমরা চেয়েছি, সেটি পাইনি। কারণ ওই চাওয়ার মধ্যে ভুল ও বিভ্রান্তি ছিল। সেই ভুলের খেসারত আজও আমরা দিচ্ছি।” ৪
“ তুমি যেই হও আর যাই কর না কেন, তুমি যখন সত্যিই কোন কিছু চাও, সেই চাওয়াটা পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে উত্থিত হয়। আর পৃথিবীর পর এটাই তোমার উদ্দেশ্য” বলেছিলেন পাউলো কোয়েলো,“ স্বপ্ন দেখা বন্ধ কর না আর শুভ লক্ষণগুলো অনুসরণ করবে” ৫
এত ব্যর্থতা, হতাশা, অপ্রত্যাশিত বিরূপ ঘটনাবলীর পরেও লেখক স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি তিনি তরুণ ও চিন্তাশীল মানুষদের জাগিয়ে তোলার চেষ্টায় সর্বদা সচেষ্ট কারণ মানুষ যা একা পারে না তা বহু জনের প্রচেষ্টায় পারে যা এক প্রজন্মে হয় না তা বহু প্রজন্মে হয়। শুভ লক্ষণগুলো আমরা চিনে নিতে পারিনি কিন্তু তবু সব শেষ হয়ে যায় না তাই তিনি স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করেন।
তিন.
বিনয় ঘোষ বলেছেন,‘ নাগরিক সমাজ গতিশীল জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে, দ্বন্দ্ব-বিরোধের শব্দ-প্রতিশব্দে মুখর, কিন্তু গ্রাম্য সমাজ গ্রাম্য রাত্রির মতো স্থির ও অচঞ্চল। ভারতের ও বাংলাদেশের গ্রাম্য সমাজের এই শান্তস্থির অচঞ্চলতা শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্ষুণœ ছিল। হিন্দু যুগে ও মুসলমান যুগে রাজনৈতিক তরঙ্গের আঘাতে অথবা রাষ্ট্রিক বিপর্যয়ের ঝড় ঝঞ্ঝায় এই গ্রাম্য সমাজের শান্তি ভঙ্গ হয়নি।’ ৬
একই ভাবে কার্ল মার্কসও বলেন,‘ ভারতের অতীতের রাজনৈতিক দিকটা যতই পরিবর্তনশীল দেখাক না কেন, এর সামাজিক দিকটা বহু প্রচীন কাল থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল।’ ৭
ভারতবর্ষের ইতিহাসে বাংলার গ্রামগুলোকে সদা অপরিবর্তিত মনে হয়, এর একটা কারণ ছিল বাংলার গ্রামগুলোতে বর্হিবিশে^ও নতুন নতুন শাসক দেশ শাসন করতে এলেও তারা গ্রাম কাঠামোতে কোন পরিবর্তন আনেননি বা বর্হিরবাংলার কোন চিন্তা এখানে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়নি। তাই গ্রামগুলো ছিল সদা ছবির মতই স্থির ও মসৃণ। সামন্তবাদী ধ্যান ধারণা বহু কাল ধরে এখানে রাজত্ব করেছে। তবুও পশ্চাতে তাকালে এ অঞ্চলে গণ আন্দোলনের অপ্রতুলতা নজরে পড়ে না। গ্রাম্য জীবনে যখনই শান্তির ব্যাঘাত ঘটেছে তখনই শান্তি প্রিয় মানুষেরা তার প্রতিবাদ করেছে-বিদ্রোহ করেছে, রক্ত দিতে কার্পণ্য করেনি। বাংলার লোক সাহিত্যে, প্রবাদ-প্রবচনে এর প্রচুর ইতিহাস প্রচ্ছন্ন রয়েছে।
‘বঙ্গ-রাঢ়-পৌ-্র-গৌড় ট্রাইবের মানুষেরা এ ভূখ-ে দীর্ঘকাল ধরেই আদিম সাম্য সমাজের ধারাকেই বহন করে আসছে। এ অঞ্চলের লোকসাহিত্য, লোকধর্ম, বাউল, গণসংগ্রামের ইতিহাস সে সাম্যই বহন করে। লৌকিক ঐতিহ্যে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা না থাকলে বাম ধারাও জনপ্রিয় হত না’। ৮
মানুষেরা শান্তিতে বসবাস করলেও শোষণ সর্বদাই বর্তমান ছিল, কোন কোন সময় এর মাত্রা অতিক্রম করলে মানুষেরা বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছে। ফকির সন্যাসী বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, যশোর –খুলনার প্রজা বিদ্রোহ, চোয়াড় বিদ্রোহ, পাহাড়িয়া বিদ্রোহ, ময়মনসিংহের হাতিখেদা বিদ্রোহ, পাগলপন্থী বিদ্রোহ, পাবনার কৃষক বিদ্রোহ, গারা বিদ্রোহ, ওয়াহাবি বিদ্রোহ, ফরাজি বিদ্রোহ, ত্রিপুরার কৃষক বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, ৫৭’র মহাবিদ্রোহ, সন্দ্বীপের বিদ্রোহ, সিরাজগঞ্জের বিদ্রোহ। এসব বিদ্রোহ ও আন্দোলন ব্যতীতও ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল জুড়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। এই সব বিদ্রোহ এটাই প্রমান করে যে, গ্রাম সমাজ যতই ছবির মত নিশ্চল আর সমৃণ হোক না কেন শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে গ্রাম সমাজ সদাই প্রতিবাদ মুখর ছিল। ধর্মীয় বর্ণবাদ, অর্থনৈতিক শোষণ আর রাজনৈতিক দুঃশাসনকে জনগণ কখনই প্রতিবাদহীনভাবে মেনে নেয়নি। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জনগণের প্রায় সব আন্দোলনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। জনগণের মধ্য থেকে না উঠে আসছে মহান নেতা না জনগণের দাবী স্থায়ী রূপ পাচ্ছে, বারবার এটাই দেখা যায় যে জনগণের আন্দোলনকে সর্বদাই ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করে দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ’৪৭ পরবর্তী বাংলাদেশ পর্যায়ে ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সবই আংশিক বা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পরিণত হয়।
১৭৫৭ সালে ইউরোপীয়দের বিজয় ছিল মূলত আবহমান কাল ধরে চলে আসা সামন্ত ব্যবস্থার পরিবর্তে উদীয়মান বুর্জোয়াদের বিজয়; সমাজে তখন গড়ে উঠছিল নানা শ্রেণি, সামন্তিয় বর্ণবাদ আর সামাজিক স্তর বিন্যাসের স্থলে জায়গা করে নিচ্ছিল নব্য ধনীক গোষ্ঠি আর দেশি বিদেশি বেনিয়া, মুৎসুদ্দিরা। এরা সকলে মিলে বাংলার সামাজিক স্তরবিন্যাসে পারিবর্তন আনার পাশাপাশি আবহমান কাল ধরে চলে আসা অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিই পরিবর্তিত করার তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। ভেঙে পড়ছি আইন-শৃঙ্খলা, সামন্তীয় রীতি-নীতি, আদর্শ-বিশ^াস, প্রথা-পদ্ধতি। এই দ্বন্দ্বের ফলে উদীয়মান মধ্যশ্রেণি ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখতে থাকে। ‘বাংলার অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক বিকাশের যে অঙ্কুর কিংবা সম্ভাবনা তখন দেখা দিয়েছিল, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নেতৃত্বে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার পরে ইংরেজরা তা নষ্ট করে দিল এবং বাংলা হয়ে পড়ল ব্রিটেনের কল-কারখানার কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্র।.. .যে উদীয়মান বাঙালি মধ্যশ্রেণির সহযোগিতায় ইংরেজরা সেদিন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইত্যাদির মাধ্যমে পরবর্তীকালে বাংলার ভূমি ব্যবস্থাকে পুর্নগঠিত করে ইংরেজরা তাদেরকে নিজেদের পদলেহী একটি শ্রেণি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিল।’ ৯
বিকৃতির দ্বিতীয় পর্যায়টি দেখা যায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতিতে। ভারতীয় জাতীয় স্বার্থ ও উদীয়মান পুঁজিকে একটি জাতীয়তাবদী চরিত্রের রূপ দেওয়ার বদলে তারা সুপ্ত ধর্মীয় চেতনাকে জাগ্রত করে নিজেদের জন্যে পৃথক ভূখ- দাবী করে। তৎকালীর রাজনীতিতে হিন্দু উঠতি পুঁজিপতি আর প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়ারা কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এর বিপরীতে মুসলমান উঠতি পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বতন্ত্র দেশ চাইল যেখানে তারা নিজস্ব পদ্ধতিতে জনগণকে শোষন করতে পারবে, এর প্রয়োজনে তারা ধর্শীয় চেতনাকে বিকৃত করে সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে কংগ্রেস থেকে ভিন্ন একটি স্বতন্ত্র ধারার বিকৃত রাজনীতির জন্ম দেয় যার ফলশ্রুতিতে অখ- ভারতের পারিবর্তে দ্বিখ-িত ভারতের জন্ম হয় এবং এই বিকৃত রাজনীতির ধারা অদ্যাবধি চলছে। ধর্মকে সম্মুখে রেখে এই যে ভারতীয় পুঁজিপতিদের দেশ ভাগের নকশা তা তৎকালীন বামপন্থিদের চিন্তায় স্পষ্টরূপ পায়নি আবার কারো কারো এই ধমীয় রাজনীতির প্রতি সমর্থন প্রচ্ছন্ন থাকেনি। কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী গঙ্গাধর অধিকারী পাকিস্তান আন্দোলনকে মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের ন্যায়সঙ্গত দাবি বলে প্রচার করেন। ১০
ইউরোপে উঠতি ধনীকদের হাতে সামন্তবাদী অর্থনীতি ও ধ্যান-ধারণার পরাজয় ঘটেছিল ফলে সেখানে পুঁজি তার স্বাভাবিক বিকাশ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল, অনুন্নত ও উপনিবেশিক দেশগুলোর দখলকৃত বাজার ব্যবস্থাও ইউরোপের পুঁজি বিকাশে সহায়ক হয়েছিল কিন্তু বাংলার উঠতি ধনীক শ্রেণি গণআন্দোলের মাধ্যমে সামন্তীয় ব্যবস্থার উৎখাত না করে ইংরেজ বণিকদের সহায়তায় দেশের স্বাধীনতাকেই বিসর্জন দিয়ে বসে। এটাই ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বিকৃত রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রথম পর্যায়। এর ফলে একদিকে শিল্প পুঁজির বিকাশ না হওয়া অপরদিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সামন্তীয় সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করাতে সাংস্কৃতিক বিকাশ রুদ্ধ হয়ে পড়ে; নব্য ধনীরা নতুন নতুন পেশায় যুক্ত হচ্ছিল কিন্তু তাদের শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল না। স্বল্প কিছু ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিতরা বাংলার সমাজ সংস্কৃতিকে অনুধাবন করে নিজস্ব চিন্তা -চেতনা গড়ে তোলার বদলে বাংলার সমাজ –সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখান করত তৎপর হয়। ওপনিবেশিক অর্থনীতি, সামন্তিয় ধ্যান –ধারণার প্রাবল্য ও গণসমাজ নানা দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ থাকার কারণে তাদের আন্দোলন সংস্কারবাদী রূপ নেয়। উনিশ শতক ব্যাপী বিবিধ সংস্কার ও অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা অব্যাহত থাকলেও বিশ শতকে মুসলমানরা রাজনীতিতে আবির্ভুত হলে ক্ষেত্র পরিবর্তিত হতে থাকে।ওহাবি, ফরাজি প্রভৃতি আন্দোলনের মাধ্যমে এক দিকে মুসলমানদের যেমন জাগিয়ে তোলা হয় অপর দিকে তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ বিশেষত মুসলীম লীগ মুসলমানদের রাজনৈতিক দাবি আদায়ে সংগঠিত করতে থাকে। মুসলিম লীগ সম্পর্কে লেখক বলেন, ‘মুসলিম লীগের মূল লক্ষ্য ছিল ঐতিহাসিক স্বার্থ এর্ব ঐহিক স্বার্থ হাসিলের প্রয়োজনেই তারা প্রচার করেছিল ইসলামের কথা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজদের সহযোগী মধ্যশ্রেণির হিন্দু অংশের সঙ্গে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করাই ছিল মুসলিম লীগের লক্ষ্য। দ্বিতীয়ত, মুসলিম লীগের আন্দোলনের পদ্ধতি ছিল ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও আপোষ –আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মতো কোন আপোষহীন পদ্ধতি তারা কোন দিনই গ্রহণ করেনি। তৃতীয়ত, মুসলিম লীগের আন্দোলন কোন পরিপূর্ণ জীবনদর্শন, জীবনপদ্ধতি ও জীবন সাধনাকে অবলম্বন করেনি-বুর্জোয়া আদশেরও আলোকে ইসলামের আধুনিকীকরলের পক্ষপাতি ছিল এ প্রতিষ্ঠান।’ ১১
বস্তুত এই যুগ ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুগ, ১৮৪৮ সালে ‘কমউিনিস্ট মেনিফেস্টো’ প্রকাশ হয়, ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব, ১৯৪৯ সালে চিন বিপ্লব বিশ^ রাজনীতিকে পথের দর্শন দিয়েছি অথচ একই সময়ে ভারতের জনগণকে জাতীয়তাবাদের বদলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে মাতিয়ে রাখা হল। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস যেখানে ব্রিটিশ পরবর্তীকালে পুঁজিপতিদের জন্য নিজ নিজ দেশ প্রতিষ্ঠার কর্মে লিপ্ত ছিল সেখানে বিপ্লবীদের প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগ কোন রাজনৈতিক চরিত্র পায়নি, জাতীয় স্বাধীনতাই ছিল তাদের বিপ্লবী চেতনার উৎস কিন্তু দেশ স্বাধীন হলে কারা দেশ শাসন করবে এবং গণস্বার্থ সেখানে কতটা সংরক্ষিত হবে সে চিন্তা তাদের বিচলিত করেনি।‘কমিউনিস্টদের আন্দোলনও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য কিংবা গণভিত্তি লাভ করেনি। তবে এসব আন্দোলনে ভীত হয়ে ইংরেজরা নানা কৌশলে মুৎসুদ্দি শ্রেণিকে আরও কাছে টেনে নিয়ে ও মুৎসুদ্দি শ্রেণির মধ্যকার হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে এ দেশকে শাসন করতে চেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত মুৎসুদ্দিদের হাতেই তারা রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করে গিয়েছে।’ ১২
বুদ্ধিজীবী-সাহিত্য-প্রচার মাধ্যম
রাজনীতিবিদদের পরে গণজীবনকে লক্ষ্যাভিমুখী করেন দেশের বিদ্বৎ সমাজ, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ কিন্তু রাজনীতির মত এই শ্রেণিটিও নানা বিভ্রান্তি ও আত্মবিক্রয়ের পথে ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল; যাঁরা সততাকে অবলম্বন করে স্বকীয় চিন্তাকে প্রচার করেছেন তাঁরা কোন গঠনমূলক চিন্তাকে গণচিন্তায় পরিণত করত পারেননি, সে প্রচেষ্টাও দেখা যায়নি। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় অদ্যাবধি চিন্তাহীন, বিনোদন নির্ভর, তুচ্ছ কাহিনী নির্ভর লেখকদেরই জনপ্রিয় করার প্রবণতা দেখা যায়। তরুণ প্রজন্মকে এভাবে চিন্তা ও চেতনাহীন সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দিয়ে মূলত গণস্বার্থকেই আড়াল করা হয়। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে এবং এর পরবর্তীতে শাসকগোষ্ঠী সব সময়ই লেখক ও বিদ্বৎ সমাজের বৃহদাংশ এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সম্পূর্ণ অংশকেই নিষ্ক্রিয় করতে বা দলের অংশীভূত করতে সক্ষম হয়েছে। আবুল কাশেম ফজলুল হক তাঁর ‘ বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য, কালের যাত্রা ধ্বনি, অবক্ষয় ও উত্তোরণ, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’ প্রভৃতি গ্রন্থে এতদ্বিষয়ে বিস্তৃত আলোকপাত করেছেন; এখানে আমরা স্বল্প পরিসরে এ প্রসঙ্গে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
‘বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য’ গ্রন্থের অধ্যায় সংখ্যা পাঁচটি। শিরোনামসূহ হল: বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য: কালের দাবি ও লেখকদের অবদান, বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য: পাঁচজন প্রাবন্ধিক ( আবুল ফজল, আবদুল হক, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চেীধুরী), বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিদ্বৎ সমাজ: তিন দশকের অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রবন্ধ ও গবেষণা: কয়েকটি প্রসঙ্গ কিছু মন্তব্য, বাংলাদেশের সাহিত্য -পরিস্থিতি: সঙ্কট ও সম্ভাবনা।
‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিদ্বৎসমাজ তিন দশকের অভিজ্ঞতা’ অধ্যায়টি লেখক দশটি পর্বে বিভক্ত করে আলোচনা করে এতদঞ্চলের রাজনীতিতে বিদ্বৎসমাজের ভূমিকা আলোচনা করেছেন।
‘এদেশে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় জীবনদৃষ্টির নিগড় ভেঙে মাথা তুলেছে যুক্তি অভিজ্ঞতা ও বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনদৃষ্টি, পরকালের দিক থেকে মানুষ দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছে ইহকালের দিকে, আর শ্রেণি-সংগ্রামের ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রসার ঘটেছে। কিন্তু সব কিছুই যেন ঘটেছে প্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে, সাধারণ মানুষ পরিচালিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের দ্বারা, বিদ্বৎসমাজ পরিচালিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের দ্বারা, রাজনৈতিক দলগুলো চলেছে স্বতস্ফূর্ত উত্তেজনার পথ ধরে।’ ১৩
ষাটের দশক ছিল সম্ভাবনার দশক, চিন্তাশীল লেখকেরা এ সময়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলা যায়, জাতির ক্রান্তিলগ্নে তাঁরা দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। দেশভাগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরে এতদঞ্চলের জনগণের মান উন্নয়নের কোন প্রচেষ্টাই করা হয়নি, বরং এ সময়ের লেখক চিন্তাবিদ-বিদ্বৎসমাজের অনেকেই প্রতিক্রিয়শীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে আশ্রয় নিয়েছেন যার ধারাবাহিকতা আজও প্রত্যক্ষ করা যায়। ‘গণআন্দোলনগুলোতে জনগণের যে চেতনার বিকাশ ঘটেছিল এবং আশা-আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটেছিল যেসব দাবি-দাওয়া ও স্লোগান উঠেছে , যে আদর্শ-চেতনা ও মতবাদ অনুসন্ধিৎসা মাথাচাড়া দিয়েছে , তার সঙ্গে তুলনায় আমাদের তৎকালীন প্রবন্ধ লেখকদের জীবনচেতনা -দৃষ্টিভঙ্গি অনুসন্ধিৎসা ও স্বদেশভাবনা যে পশ্চাৎবর্তী ছিল তার ভূরি ভূরি নজির উপস্থাপন করা যায়।’ ১৪
এই যুগসন্ধিক্ষণে জাতি প্রগতিশীল লেখকদের নিকট থেকে গণতন্ত্র,সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তান, ইসলামি বিশ^ ও আমেরিকার মত প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের রূপ কী হওয়া উচিত এবং জাতিকে কীভাবে -কোন নীতির দ্বারা গড়ে তোলা যায় এর সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ মতামত দাবি করেছিল কিন্তু অদ্ভূতভাবে লেখকেরা এবিষয়ে নীরব থেকেছেন বা অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শ্রম দিয়েছেন। প্রতিকূলতার কথা অনেকে বলেন কিন্তু এটাও তো সত্য যে প্রতিকূল সময়ই মহৎ প্রতিভার জন্ম হয়। অথচ স্বাধীনতার পরবর্তীতে চীন ও রাশিয়ার প্রভাবে
এবং দেশের প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ ও বাম ধারার দলগুলোর ভূমিকা বিবেচনা করে যখন সংবিধানে চার নীতি গ্রহণ করা হল তখন এর গুণগান করার মত চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী-লেখকের অভাব ছিল না। এটা সর্বদাই দেখা যায় সরকার যখন যে নীতি নেয় তারই গুণগান করার মত লেখক-বুদ্ধিজীবীর অভাব হয় না, কেবল সরকারি নীতির প্রতীক্ষায় না থেকে জনগণের জন্য কী ধরণের শাসন ও রাজনীতি দরকার, গণতন্ত্র মানে যে কেবল ভোট নয় সেটা বিদ্বৎসমাজ খুব একটা বলেন না। আবার ১৯৭৫ সালের পরে বিভিন্ন সরকার সংবিধানের মূলনীতিসমূহ পরিত্যাগ, বিকৃত, সংশোধন করলে এর পক্ষেও চিন্তাবিদের অভাব দেখা যায়নি। এসব চিন্তাবিদেরা ঘটনাত্তোর সময়ে চিন্তা করতে অভ্যস্ত বা গণস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠায় তৎপর হন।
লেখকদের বৃহদাংশ কলাকৈবল্যবাদে নিমজ্জিত ছিলেন, রাজনীতি ও কল্যাণের চিন্তার বদলে তাঁরা নিয়োজিত ছিলেন নান্দনিকতা চর্চায়। বুদ্ধদেব বসু, প্রমথ চৌধুরী, জীবনানন্দের ধারাবাহিকতায় তাঁরা আধুনিকতা, পোস্টমর্ডানিজম প্রভৃতি তত্ত্বের দিকে মনোযোগী হন। এদেরে অনেকে নিজেকে পরিচয় দেন,‘ অসুস্থ-অস্বাভাবিক-বিকারগ্রস্ত-রুগ্ন-মাতাল-উন্মাদ-বিকল-নিঃসঙ্গ-যৌনতাস্পৃষ্ট-বিকারগ্রস্ত ’ ইত্যাদি বলে। আধুনিকতা ও পোস্ট মর্ডানিজমের অন্ধকূপে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন কেউ কেউ। ‘ যা সকলের দৃষ্টিগোচর, প্রাবন্ধিকেরাও তাতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন, উপরিতলের গভীরে প্রবেশ করে অদৃষ্ট সত্যকে অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে আবিষ্কার করার শ্রম কবুল করতে চাননি কেউই। শিল্পীর স্বাধীনতা, লেখকের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনায় লেখকদেরকে প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে সমাজতন্ত্র বিরোধী মহল থেকে।’ ১৫
একালের বহুল আলোচ্য বিষয় ছিল-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাহিত্য তত্ত্ব, অতীতের গৌরব কথা, আত্ম সন্ধানের কথাও তাঁরা বলেছেন কিন্তু দেশ কী করে গঠিত হবে, কারা কী প্রকারে রাষ্ট্র গঠন করবে, জনগণের শাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে বিদ্বৎসমাজ দৃষ্টি দেননি। দ্বিজাতি তত্ত্বের রাজনীতির মোহ থেকে জনগণকে মুক্ত করে গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক চেতনার আলোকে জনগণকে নতুন দিশা প্রদান করার দায় থেকে তাঁরা মুক্ত থেকেছেন। এসময়ের প্রিয় বিষয় ছিল-বর্ণমালা ও রবীন্দ্র বিতর্ক, অথচ ১৯৫২ সালেই এর মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল। বাঙালির সংস্কৃতি, ভাষার কী হবে, রবীন্দ্রনাথ বাঙালিরা পড়বে কি না তা বায়ান্ন সালেই বাঙালিরা নির্ধারণ করেছিল, নতুন করে এ বিতর্কে শক্তিক্ষয় করার প্রয়োজন ছিল না, এ সময়ের দাবি ছিল জনগণের চেতনার মান উন্নত করা এবং জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তাকে জাগ্রত করা। কিন্তু লেখক চিন্তাবিদরা চর্বিতচর্বনে ব্যস্ত থাকলেন।
‘ ১৯৬৮ -৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানের অনতিপূর্বে যে রাজনৈতিক অবস্থা দেশে বিরাজমান ছিল, তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর বর্ণমালা সংক্রান্ত তাত্তি¦ক বিতর্ক আর্থ-সামাজিক সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ারই সহায়ক হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রসঙ্গ অত্যন্ত সচেতনভাবে ও যতœ সহকারে পরিহার করেছেন প্রায় সকল লেখক। অথচ রাজনৈতিক বিষয়ই একালে প্রবন্ধের সর্বপ্রধান উপজীব্য হতে পারত।’ ১৬
চিন্তাকে মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত এই বিতর্ক নানাভাবে চলতেই থাকে। স্বরূপ সন্ধানের এই বিতর্কে দেশের সকল লেখক-কবি-চিন্তাবিদই যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।
পঞ্চাশের দশকে ‘কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডোম, ও ‘পেন’ এবং ষাটের দশকে আইয়ুব সরকার লালিত ‘পাকিস্তান লেখক সঙ্ঘ-পূর্বাঞ্চল শাখা’ সক্রিয় ছিল। প্রগতিশীল লেখকেরা প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন; তাঁরা পারতেন স্বতন্ত্র মঞ্চে থেকে জনগণের নিকট তাঁদের চিন্তা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের লেখকগণ অদ্যাবধি-সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িক, সরকারি-বেসরকারি, সমাজবিচ্ছিন্ন এই তিন ধারায় বিভক্ত। বর্তমানে আর এক ধারার লেখক দেখা যায় নাম উল্লেখ না করে বলা যায় এঁরা কেবল সস্তা সেকেলে বিনোদনকেই সাহিত্য মনে করেন, চিন্তাহীন -হালকা রস রসিকতার মাধ্যমে তাঁরা তরুণ পাঠকদের বিভ্রান্ত করে মূলত জাতীয় চিন্তাকেই ধ্বংস করছেন। মান সম্পন্ন সাহিত্য ও লেখা নির্মাণে প্রকাশক, মিডিয়ার দায়িত্বও অস্বীকার করা যায় না। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মত অদ্যাবধি কেবল কাহিনি নির্মান আর নতুন নতুন ফর্ম তৈরি করাতেই লেখকেরা ব্যস্ত। সমাজ রাজনীতি তাঁদের চিন্তায় স্থান পায় না। ‘সমাজের বিবেক’ ‘মহতের কাতারে দাঁড়ানো’ ‘ মিডিয়া সর্বস্ব’ ‘এনজিও-ক্ষুদ্র ঋণের চিন্তক’ লেখকেরা আজও সাহিত্য ও জাতীয় চিন্তার প্রধান ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাকে লেখকেরা দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত করেন, এক ধারায় লেখকেরা বলতে চান যে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল গৌরবজনক; মাযহারুল ইসলাম, নীলিমা ইব্রাহীম, কবীর চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ এই ধারায় বুদ্ধিজীবীদের মূল্যায়ন করেন। অপরপক্ষে যাঁরা বলতে চান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা প্রশংসনীয় নয় তাঁদের মধ্যে রয়েছেন-আহমদ শরীফ, আবদুল হক, সরদার ফজলুল করিম, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আহমদ ছফা প্রমুখ।
‘যুদ্ধোত্তর আট বছর: বাংলাদেশ পর্যায়’ অংশে লেখক বাংলাদেশের সাহিত্য প্রবণতার ওপর দৃষ্টি দিয়েছেন। একালে সব ধারার সাহিত্যিকদেরই দেখতে পাওয়া যায় তবুও বলতে হয় এখনো যাঁদের জনগণের সম্মুখে তুলে ধরা হয়, যাঁদের সাহিত্যকে তথাকথিত জনপ্রিয় করা হয় –প্রশ্ন হল তাঁদের বিনোদনের সাহিত্য আর বিক্ষিপ্ত- বিচিত্র- পাঁমিশালি চিন্তা তরুণসমাজকে কতটা দিকনির্দেশ প্রদান করতে পারে। ‘বিত্তহীনের বিদ্যা নয়, বিত্তবানের বিদ্যাই –ঊনিশ বিশ শতককে নিয়ন্ত্রণ করেছে।’ বলেছেন বিনয় ঘোষ। ১৭ সেকালের আত্মীয় সভা, তত্ত্ববোধিনী সভা, বেথুন সোসাইটি, সুহৃদ সমিতি, সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা, সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা, বিদ্যোৎসাহিনী সভা, গুড উইল ফ্রেটানিটি, সঙ্গাত সভা প্রভৃত তৎকালীন প্রায় সব চিন্তার ক্ষেত্রগুলোকেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন বিত্তবান বিদ্বানেরা।
বর্তমানের বিদ্বৎ সভাগুলো চালায় এনজিও, কর্পোরেট হাইস ও বিদেশি দাতারা, পুঁজি সব পণ্যেরই যোগান দেয়, বিত্তবান বুদ্ধিজীবী, লেখক, চিন্তাবিদেরা বর্তমানে রাষ্ট্রচিন্তার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে সেকালের সভাগুলো ছিল উদারমানবতাবাদী, ধনতন্ত্রের উপযোগী করে তারা দেশকে গড়ে তুলছিলেন। একালের বুদ্ধিজীবীরা আরো বেশি শক্তিশালী, তাঁরা সরাসরি বিদেশি শক্তির সঙ্গে দেশি শাসকদের লিয়াঁজো করে দেন। এবং সবটাই হয় গোপনে, জনগণ তাঁদের কর্মপ্রক্রিয়া, উদ্দেশ্য, সভাসমিতি কিছুই দেখতে পায় না। ১/১১ এর পরে সিভিল সোসাইটির কিছু সভাসমিতি নজরে পড়েছিল কিন্তু জনগণ এর লক্ষ্য- উদ্দেশ্য কিছুই জানতে পারেনি।
উনিশ শতকের ইয়ং বেঙ্গলরা অনেকে ছিলেন বিত্তবান, বিশ শতকের ইয়ং বেঙ্গলরা হলেন বিত্তহীন আর একবিংশ শতকের ইয়ং বেঙ্গলরা অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত তাই তারা আশ্রয় নেন অস্তিত্ববাদ, পরাবাস্তববাদ, আধুনিকতাবাদী তত্ত্বে।
ষাটের দশকে তখনো ঢাকা শহর গড়ে ওঠেনি, মহানগরের কোন চিহ্নই সেখানে ছিল না, লেখক বলতে আমরা আজ যাদের চিনি তাঁরা অধিকাংশই গ্রাম থেকে আগত ভাগ্যান্বেষী; গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর সা¤্রাজ্যবাদের জটিল চিন্তার বদলে পশ্চাতে রেখে আসা গ্রামই তাঁদের চিন্তা চেতনার অনেকাংশ জুড়ে ছিল। গণতন্ত্র কী? সমাজতন্ত্র কী ? আর গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে কীভাবে একটা জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র গড়ে তোলা যায়-এই জটিল ও বিপজ্জনক কর্মের শ্রম নিতে চাননি অনেকেই। ‘গ্রামের সাধারণ মানুষ নিয়ে একটা পুরো দশক ধরে আমাদের যথেষ্টই লেখা হয়েছে কিন্তু আমাদের সাহিত্য থেকে আমরা সত্যি করেই জানতে পারিনি কেমন আমাদের গ্রাম। কথা সাহিত্যে পেয়েছি বাংলাদেশের গ্রামের স্থিরচিত্র, দুঃখ বা সুখের গ্রাম হারানোর বিলাপ, শহর জীবনের প্রতিতুলনায় গ্রামের নিশ্চিন্ত নির্ভয় কোটরগত জীবনযাপনের মোহ।’ ১৮
তাঁদের আর একটি অবলম্বন ছিল, সেটা লেখকের ভাষায় বলা যাক,পঞ্চাশের দশকে যে নতুন সাহিত্যেকেরা আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা আন্তরিকভাবে সাহিত্য সৃষ্টিতে নিয়োজিত রয়েছেন, তাঁদের রচনা লক্ষ করলে দেখা যায়, ত্রিশের ‘আধুনিক’ দের নৈরাশ্যবাদই তাঁদের অবলম্বন। কল্লোল ও কবিতার ধারায় আগত পশ্চিম বাংলার লেখকদের চেয়ে তাঁরা এক পা-ও অগ্রসর হতে পারেননি। তমুদ্দুনপন্থীদের সঙ্গে তুলনায় তাঁদের ধ্যান-ধারণাকে প্রগতিশীল বলে মনে হলেও আজকের দুনিয়ার প্রগতিশীল ¯্রােত থেকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন। তাছাড়া ব্যাপ্ত স্বদেশের বৃহত্তর জনসাধারণের সঙ্গেও তাঁদের সংযোগসূত্র ক্ষীণ।’ ১৯
‘টেনিসনের সেই সহজপাঠ্য কবিতা, ‘লোটস-ইটার’- এই যে একটা ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে, ঘুম-ঘুম বেঁচে থাকা, পরিশ্রম থেকে দূরে থাকা, দুশ্চিন্তা থেকে দূরে, ইন্দ্রিয় সংবেদী অবসাদের মধ্যে আকণ্ঠ নিমগ্ন থাকা অহোরাত্র সেই ইচ্ছা বুদ্ধদেব বসুর এবং তাঁর উত্তরসূরীদের কাব্যের মূল কথা। আমাদের প্রেক্ষাপটে বুদ্ধদেব বসু গ্রহণযোগ্য নয়।’ ২০
দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ পরবর্তীতে সুরিয়ালিজম, পোস্টমর্ডানিজমের অন্তরালে আশ্রয় নিয়েছেন কেউ কেউ, পরিকল্পিত চিন্তা বিশ^যুদ্ধ রোধ করতে পারেনি তাই চিন্তার কোন কেন্দ্র দরকার নেই-এটাই ছিল এসব মতবাদের মূল কথা। চিন্তার কেন্দ্রগুলোকে ভেঙ্গে ফেলে তাঁরা সমাজ রাজনীতি থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার পক্ষপাতি। তাঁদের সাহিত্য দুঃখ -যন্ত্রণায় ভরপর কিন্তু এর নেই কোন উজান-ভাটি। এসব পাঠ করে পাঠকের দুঃখবোধই কেবল আরো জাগ্রত হয় কিন্তু চিন্তা বা চেতনা জাগ্রত হয় না। সাহিত্যের এই ধারা আজও অব্যাহত। ‘উত্তর-আধুনিকতা, সুরিয়ালিজম এসব হল একবিংশ শতাব্দীর ভাববাদ।’ ২১ হুমায়ুন আজাদ রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন, ‘বহিরস্থিত।’ ২২ কবিরা বহিরস্থিত হন তাঁরা সমাজ, রাষ্ট্র বা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন না, তাঁদের মাথার ভেতর কী যেন এক বোধ কাজ করে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উন্নত ব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতির নির্মাণ করেছেন, বিকৃতি, নৈরাশ্যবাদের বিরোধী ছিলেন তিনিও। ত্রিশের দশকের সাহিত্যিকেরা সাহিত্যের কেবল বিমানবিকীকরণই করেননি, বিকৃতও করেছেন। বাংলা বিভাগের ছাত্ররা ওই যুগের সাহিত্য পড়তে পড়তে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে অনেকাংশে। আধুনিকাতাবাদী সাহিত্য সম্পর্কিত আলোচনায় লেখক জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে বলেন, ‘ তাঁর মন খুব বেশি স্পর্শকাতর, রুগ্ন-অনুভূতিগুলো নরম, কোমল, বিষণœতাভরা। অন্ধকার ও খারাপের দিক এবং অকল্যাণের সম্ভাবনা ও অমঙ্গলবোধ তাঁর মনকে আচ্ছন্ন রেখেছে-কদাচিত তিনি সেই আচ্ছন্নতা কাটাতে পেরেছেন।’ ২৩
বুদ্ধিজীবীরাও আর সেকেলে হয়ে নেই, তাঁরা এখন আর বুদ্ধিজীবী বা বিদ্বৎসমাজ নন তাঁরা এখন সিভিল সোসাইটির অর্ন্তভুক্ত। ১/১১ এর সময় এনারাই সরকার গঠন করে দিয়েছেন, (সরকার গঠন করে ঘোষণাও দিয়েছে , এই সরকার আমরাই এনেছি।) ‘ এক দঙ্গল বৃদ্ধিজীবী শহিদ মিনারে জনসমাবেশ করে সেখান থেকে গাড়ি বহর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, প্রভৃতি রাষ্ট্রের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে গিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্য চেয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন। রাজনীতিতে এই বুদ্ধিজীবীরা ভীষণভাবে সক্রিয় ছিলেন ১৯৮০ ও ১৯৯০ –এর দশকে। এরা এক সময় আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত ছিলেন, এখন দেখা গেল এরা সিভিল সোসাইটি, এনজিও, বিদেশি দূতাবাসসহ আরও নানা কিছুর সঙ্গে যুক্ত।’ ২৪
এরাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে পশ্চিমাদের ডেকে এনেছে, দৃশ্যমান ঘটনার আড়ালে রয়েছে আরো অনেক অজানা কাহিনী। তাঁরা নিজেদের সিভিল সোসাইটি বলে পরিচয় দেন। এই বুদ্ধিজীবীরাই ‘একদফা ভিত্তিক রাজনীতি’ চালু করেছিল। এই এক দফা শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার এক দফা। জন-অধিকার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণদাবির এখানে কোন আলোচনাই নাই। এখন সরকারি দল বিমূর্ত আর খাপছাড়া উন্নয়নের কথা বলেন আর বিরোধী দল বলছে: একদফা এক দাবি -তুই কবে যাবি ইত্যাদি। এভাবে রাজনীতি থেকে জনদাবি, গণতান্ত্রিকতাকে বাদ দিয়ে রাজনীতি কেবল নগ্ন ক্ষমতার লড়াই-এ পরিণত করা হয়েছে। জনগণকে সব সময় বিশ^াস করানো হয় সরকার পরিবর্তিত হলেই তাদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটবে, বাস্তবে তাদের সমস্যা-দাবি নিয়ে কোথাও আলোচনাই হয় না। বামেরা চুল চেরা বিশ্লেষণ করে বটে তবে তারা কখন তত্ত্ব নির্ধারণ করে উঠতে পারে না। এভাবে রাজনীতি হয়ে ওঠে স্লোগান সর্বস্ব- অন্তঃসারশূন্য।
জিয়ার মৃত্যুর পরে সিভিল সোসাইটির বুদ্ধিজীবীরাই ‘নাগরিক কমিটি’ গঠন করে আওয়ামী লীগ জোটের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ওসমানীকে জোট থেকে সরিয়ে এনে নাগরিক কমিটির প্রার্থী করে নির্বাচন করিয়েছিল অচীরেই যার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়, এবার তারা ড. ইউনুসকে দিয়ে সে প্রচেষ্টা করেছিল। এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরে অপর একদল বুদ্ধিজীবী গঠন করেছিল, ‘একত্রিশ বুদ্ধিজীবী গ্রুপ’ তারপর ‘ স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কমিটি’ এরপরে অন্য একটি ‘নাগরিক কমিটি’। এছাড়া মুক্ত ফোরাম, গণতান্ত্রিক ফোরাম ইত্যাদিও তারাই ভিন্ন ভিন্ন সময় গঠন করেছিল। এরশাদ সুহার্তোর মত দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকবে এটাই সকলে ধরে নিয়েছিল কিন্তু এই বুদ্ধিজীবীরাই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিপিবি, ওয়ার্কাস পার্টি, বাসদ, জাসদ ও ছাত্র সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করেছিল। তাঁরাই এরশাদের পতন ঘটিয়ে তথাকথিত গণতন্ত্র কায়েম করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা তাঁরাই দিয়েছেন, এবং ‘তাঁরাই ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের সঙ্গে এরশাদের সমঝোতার মাধ্যমে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগের বন্দোবস্ত করছিলেন। এরশাদের পদত্যাগের পর তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হয়ে মন্ত্রি পরিষদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার জন্য অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ লোক নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার তৈরি করেছিলেন।’ ২৫
মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক-বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্মরণ করা যায়। এম আর আকতার মুকুলের ‘মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা’ গ্রন্থে এর কিছু তথ্য পাওয়া যায় কিন্তু ষাটের দশকে বুদ্ধিজীবী, লেখকদের ব্যর্থতা জাতির জন্যে যে কর্মফল তৈরি করেছে সেপথেই চলেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে লেখক বলছেন, দেশের বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বৎসমাজ তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়েছে। তাঁদের প্রথমটি কলকাতা ও ভারতীয় সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ করছে, দ্বিতীয়টি চলছে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে, দেশ-কালের দাবি উপেক্ষা করে, মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ইতিহাসে নিজেদের সংস্কৃতির উৎস সন্ধান করছে। তৃতীয় এবং সব চেয়ে শক্তিশালী ধারাটি ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদের তাঁবেদার। প্রায় সব ধরণের চিন্তাশীলদের মধ্যেই দেখা দিয়েছে কপট প্রগতিশীলতা। বুদ্ধিজীবীদের একাংশ ‘মুৎসুদ্দি বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সংস্কৃতিকে তাঁরা আবদ্ধ করেছেন নাচ-গান আর গতানুগতিক কিছু আলোচনায়। বাংলাদেশের প্রগতিশীল সব শক্তি এর জন্যে কেবল মৌলবাদিদেরই দায়ী করে আসছে কিন্তু তাঁরা নিজেদের দুর্বলতা, ত্রুটিবিচ্যুতি, বিপথগামিতা নিয়ে আত্মানুসন্ধান করতে একটুও আগ্রহী নয় ফলে ‘শিখা’ গোষ্ঠীর ধারাবাহিকতায় যে মুক্তবুদ্ধির চেতনা বিকশিত হয়েছিল তা আজ ক্ষয়িষ্ণু বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ২৬
ছয় দফা আন্দোলনের সময় পর্যন্ত এদেশে কোন জাতীয় ইতিহাস রচিত হয়নি, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে কোন দল বা গোষ্ঠীর কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কোন সংগঠনের অভ্যন্তরেও কোন ধরণের নৈতিক অনুশীলন দেখা যায়নি। আইন-কানুন ও বিধি- ব্যবস্থা জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অনুকূল নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই এই শূন্যতা পূরণ করার প্রয়োজন ছিল কিন্তু এর কোন উদ্যোগই দেখা যায়নি। ২৭ পূর্ববর্তী সময়ে, মুসলিম সাহিত্য সমাজ, তমদ্দুন মজলিস, নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘ প্রভৃতি মাধ্যমে যে আপাত শৃঙ্খলা ও চিন্তার ধারাবাহিকতা গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ পর্বে তা বিনষ্ট হয়েছে। ২৮
চার.
যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি
‘রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি’ তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রথম বাংলাদেশ সরকার, রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কোন পথে, অবক্ষয় ও উত্তরণ, রাজনীতি ও দর্শন, প্রাচুর্যে রিক্ততা, বিশ^ায়ন ও সভ্যতার ভবিষ্যত, রাজনীতি ও সংস্কৃতি: সম্ভাবনার নব দিগন্ত, গণতন্ত্র ও নয়াগণতন্ত্র বাংলাদেশের রাজনীতিতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা প্রভৃতি গ্রন্থে লেখক যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রবণতার বিষদ আলোচনা করেছেন।
বর্তমান ও অতীত বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রবণতাসমূহ প্রত্যেকই জানেন তবে ঘটনার বিশ্লেষণ সবাই সমউদ্দেশ্যে করেন না। একই ঘটনা বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্নভাবে প্রতিপন্ন হয়, আবার ঘটনার পশ্চাতের কারণগুলো প্রায় সব ক্ষেত্রেই জনচক্ষুর আড়ালে থাকে, দেশ হিতৈষী কোন কোন সুচিন্তক এর মর্মোদ্ধার করতে পারেন। আবুল কাসেম ফজলুল হকের লেখায় তাঁর স্বতন্ত্র চিন্তা, দেশপ্রেম আর অকৃত্রিম আন্তরিকতা পাঠক অতি সহজেই অনুধাবন করবেন। বাংলাদেশ সম্পর্কিত তাঁর চিন্তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় সব গ্রন্থে, দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ চিন্তার বাইরে তিনি খুব বেশি লেখেন না। একাত্তরে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেটা ছিল জনযুদ্ধ, জনগণ একটা নতুন দেশ, একটা নতুন সময় ও নতুন জীবনের আশায় যুদ্ধ করেছিল। সেই আশা আজ সুদূরপরাহত, শহীদদের রক্তের দাগ শুকিয়ে যাবার পূর্বেই শুরু হয়েছিল দুর্নীতি, লুটপাট, হত্যা, হীনতা-নীচতা, এর ফলশ্রুতিতে চুয়াত্তরে বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হল। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আর ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান যারা দেখেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন তারা কী করে দেশকে দুর্ভিক্ষের কবলে ঠেলে দিতে পারে তা সে সময় অনেকেই বুঝে উঠতে পারেননি। বাঙালির হীনতা-নীচতার দুর্নাম হয়তো কোনদিন দূর হবে না। ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে আহমদ ছফা বলেন, ‘ ঊনসত্তরের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের পর দেশব্যাপী হা-অন্ন-হা অন্ন এমন হাহাকার ওঠেনি, মানুষের লাশ এমনি পথে-ঘাটে পড়ে থাকতে দেখা যায়নি, অর্ধমৃত কঙ্কালসার নর,উদোম নর-নারীর অন্তহীন মিছিল শহরের রাজপথে ধুঁকে ধুঁকে মরবার জন্য এমন মরিয়া হয়ে ছুটে আসেনি। জিনিসপত্রের দাম একলাফে আকাশে চড়ে নাগরিক সাধারণের জীবনকে এমন বিপর্যস্ত করে তোলেনি।’ ২৯
দেশের বিবেকবান মানুষেরা ভাবেন-বাঙালিদের এই চরিত্রদৈন্য কোথা থেকে এল? কেউ কেউ বলেন, বাঙালির চরিত্র তো কোন কালে ছিলই না! বাঙালিরা চরিত্র গড়ে তোলার সুযোগ পেল কবে? হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন ‘বাঙালি: একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠি’। প্রাগৈতিহাসিক যুগে তারা বনে জঙ্গলে বাস করেছে, এরপর সেন, পাল, পাঠন, তুর্কিসহ অনেক জাতির রক্ত তাদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে; বিভক্তির রাজনীতির শিকার তারা হয়েছে একবারে শুরু থেকেই, তাই এই চরিত্র দৈন্য। পাল সেন আমলে তারা দেখেছে রাজা, মুসলমান আমলে দেখেছে বাদশা, ইংরেজ আমলে শাসক। এই প্রভুরা কেউই গণচেতনার মানকে উন্নত করতে আসেননি। তারা কেবল কর পেলেই তুষ্ট হতেন, এরই মধ্যে মধ্যে দুচার জন মির্জাফরও জন্মেছে। উনিশ বিশ শতকের রেনেসাঁর আলো এত ক্ষীণ ছিল যে তা শহর পেরিয়ে গ্রাম পর্যন্ত যেতে পারেনি। আর বর্তমানে বাঙালিরা নিজেরাই শাসক।
দেশে আজ দৃর্ভিক্ষ নেই, বলা হয় খাদ্যে দেশ স্বয়ং স্বম্পূর্ণ কিন্তু গ্রামে গ্রামে শহরের বস্তিতে এমনকি মধ্যবিত্তদের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যায় জনমনের ও জনদুর্ভোগের প্রকৃত চেহারা। জীবন উপভোগের বিষয় বাদ দিয়ে কেবল স্বস্থির সঙ্গে বাঁচতে হলে যেটুকু আর্থিক নিশ্চয়তা দরকার তা তাদের নেই। এই হতাশা, ক্ষোভ দেখে এটাই মনে হয় যে, ’৬৯ আবার আসন্ন। সেটা কখন, কীভাবে আসবে তা কেউ জানে না, সেবারও হয়তো ‘বেহাত বিপ্লব’ হয়ে যাবে কিন্তু জনমানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেমে থাকবে না। উঠতি ধনীকদের সহায়তায় ইংরেজরা এদেশের স্বাধীনতা পদদলিত করেছিল, তাদের উত্তরসূরিরা আবার সংগঠিত হচ্ছে, আরো শক্তিশালী হচ্ছে, তাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে ও দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে প্রগতিশীল শক্তিসমূহ। সেই দেশপ্রেমহীন মুৎসুদ্দিরা আজো জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করতে পারেনি, এক সময় তারা ইস্ট ই-িয়া কম্পানীকে ডেকে এনে ক্ষমতায় বসিয়েছিল এখন ডেকে আনছে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে।
‘ ১৯৭০-এর দশকে নয়া-উপনিবেশবাদী বিশ^পরিকল্পনা ও নির্ভরশীলতা তত্ত্বের ধারায় পরিকল্পিত হয়েছে নিউ ইন্টারন্যাশনাল ওয়াল্ড ইকোনমিক ওর্ডার এবং দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে গড়ে তোলা হয়েছে নানা ধরণের এনজিও।’ ৩০ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে-তথাকথিত উদারতাবাদ, নিঃরাষ্ট্রবাদ, বিশ^ায়ন, উদার গণতন্ত্র, মুক্তবাজর অর্থনীতি, বহুত্ববাদ, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ প্রভৃতি ধারণা।
সা¤্রাজ্যবাদী এই দেশগুলো দুর্বল দেশগুলোকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এসব দেশে তারা গড়ে উঠতে দিচ্ছে না গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক চেতনা। এর জন্যে তারা ধৈর্যের সঙ্গে ওসব দেশের দলগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে চলেছে। বিবিসি, ভযেস অব আমেরিকা, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি প্রচার মাধ্যমসমূহ তৈরি করছে জাতীয় হীনমন্যতা। বাংলাদেশকে তারা কখন বলছে, তলাবিহীন ঝুরি, কখন বলছে ব্যর্থ রাষ্ট্র, কখন বা দুর্নীতিতে প্রথম। তারা গণতন্ত্র প্রচার করছে আবার এর চেতনাকেও নষ্ট করছে। গণতন্ত্র বলতে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায়, জনগণকে কোন কোন অধিকার দিলে গণতন্ত্র হয় এসব জনগণের নিকট উপস্থাপন করছে না। এই সব নয়া-উপনিবেশবাদী দেশগুলো দুর্বল দেশগুলোতে গণতন্ত্র চায় না, সমাজতন্ত্র চায় না এমনকি ধনতন্ত্রও চায় না। বিভেদ, দুর্নীতি, ধর্মের কোন্দলে এরা চিরকাল দুর্বল আর আশ্রিত হয়ে থাক এটাই তাদের পরিকল্পনা।
সা¤্রাজ্যবাদেরই আর একটি রূপ বিশ^ায়ন, বিশ^ায়নকে তারা মানুষের নিকট উপস্থাপন করেছে আন্তর্জাতিকতাবাদ বলে। আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশে^র মানুষেরা নানাদিক দিয়ে পরস্পরের নিকটে আসে অপরপক্ষে বিশ^ায়ন শোষণ ও ভেদাভেদ বৃদ্ধি করে মানুষে মানুষে দূরত্ব আরো বাড়িয়ে দেয়। ‘পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা সত্যি সত্যি পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছি-এমন ভাবনা তো নিতান্তই ভ্রান্তিবিলাস মাত্র। আমার দেশের মত এরকম যত দেশ এক সময়ে ছিল পুরনো উপনিবেশের অধীনে, সে-রকম সব দেশের মানুষের সামনেই আজ বিছিয়ে দেয়া হয়েছে নতুন এক ভ্রান্তিবিলাসের মায়াজাল। নতুন এই মায়াজালটির নাম-বিশ^ায়ন।’ ৩১ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় জর্জ বুশ যে নতুন বিশ^ব্যবস্থা তৈরির কথা বলেছিলেন তা এতদিনে পূর্ণতা পেয়েছে।‘ নতুন বিশ^ব্যবস্থার মূল চরিত্রটি আপাত রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক-সামরিক।..ওয়াশিংটনের কাছাকাছি যাওয়ার আগ্রহ থেকে এখন জন্ম নিয়েছে ওয়াশিংটনের বলয়ে নিজের স্থান করে নেওয়ার ব্যগ্রতা।’ ৩২
উনিশ –বিশ শতকের বাবুরা এখন পরিণত, তারা দেশের ভেতরে আলাদা আলাদা উপনিবেশ স্থাপন করছেন, তাদের দুটা জিনিস খুব বেশি করে দরকার। এক. জলজাহাজ দুই. উড়োজাহাজ। প্রথমটি দিয়ে ইউরোপ আমেরিকা থেকে ভোগ্য পণ্য আসবে আর দ্বিতীয়টি দরকার দেশে গোলযোগ হলে পলায়নের ক্ষেত্রে। ৩৩
মৌলবাদ নাম দিয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক প্রচার চালিয়ে বিভেদ-বিশৃঙ্খলা বাড়িয়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলা হচ্ছে, এই সব বিশৃঙ্খলার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে জনগণের দাবি, গণচেতনা। মানুষকে বিভক্ত করা হচ্ছে নানাভাবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি-বিপক্ষের শক্তি, সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িক, স্বৈরাচার-অস্বৈরাচার, মৌলবাদী-অমৌলবাদী, বাম-ডাম প্রভৃতি। এছাড়াও আরো নানা শ্রেণিতে বাংলাদেশের মানুষ আজ বিভক্ত। এসব বিভেদের রাজনীতিতে দেশের বুদ্ধিজীবীরাও বিভক্ত, তারাও নানা শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে আছেন। তাঁরা বিমূর্ততার সাথে দেশ, সংস্কৃতি, জাতি, সড়ক দুর্ঘটনা প্রভৃতি বিষয়ে মতামত দেন, লেখেন, আলোচনা করেন, শিল্প-সাহিত্যের অতি দুর্গম স্থানেও তাঁরা যাতায়াত করেন কিন্তু যেটা আমাদের চিরকালীন সমস্যা-গণতন্ত্র কী? জনগণকে কী করে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায় সেসব বিষয়ে তাদের মৌন থাকতে দেখা যায়। উপরিস্তরের কিছু গতানুগতিক আলোচনাতেই তাঁরা সীমাবদ্ধ থাকেন। তাঁরা সরকারের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীই থাকতে চান জনগণের মুক্তিদাতা হতে চান না। ‘উন্নয়ন’-এর আলোচনায় তারা অনেকটা সময় ব্যয় করেন, কিন্তু এই উন্নয়নের ধারণা আরো স্পষ্ট হওয়া দরকার। এনজিও আর ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায়ীরা এখন উন্নয়নের অংশীদার হয়ে উঠেছে, ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে অনেকে নোবেল পুরস্কার পান আবার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য দূর করলে সরকারের কৃতিত্ব থাকে কোথায়? ৩৪
দলগুলোর ক্ষমতার লড়াই হচ্ছে দেখার মত, গণতান্ত্রিক লক্ষ্যকে সমুন্নত করতে পারস্পরিক সহযোগিতার বদলে তারা গদি দখলের লড়াই করতে তৎপর হয়েছেন। বিপক্ষকে এখন আর কেউ পরাজিত করতে চায় না, চায় ধ্বংস করে দিতে। মৌলিক গণতন্ত্রের সংস্কার করা কোন রূপ হয়তো জাতি খুব শীঘ্রই দেখতে পাবে। রাজনীতি এখন কেবল রাজারাই করে না এটা এখন গ্রাম পর্যায়ে অনুপ্রবেশ করেছে, ঘরওয়াপসি শুরু হবে অল্প দিনের মধ্যেই। ভারতে আছে পঞ্চায়েত, রাশিয়ায় ছিল সোভিয়েত, লেনিন সোভিয়েতগুলোর হাতে ক্ষমতা দিতে বলেছিলেন-এতে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারীতা কমবে আর এক সময় রাষ্ট্র শুকিয়ে মারা যাবে। ৩৫
লেনিন চেয়েছিলেন ক্ষমতা দেশের জনগণের হাতে তুলে দিতে, দেশের প্রকৃত ক্ষমতা থাকবে জনগণের হতে, এটা হল রাষ্ট্র বিলুপ্তির কাজে হাত দেওয়া, সেটা না করার কারণেই রাষ্ট্র আরো বলবান হয়ে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করেছে, নিঃসঙ্গতার তত্ত্ব বাস্তবায়িত হয়েছে। ৩৬ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমাদের শাসকেরাও জনগণের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে তৎপর, তাই ঘরঘর থেকে রাজনীতিক সংগ্রহ করা হচ্ছে। লেনিন যা পারেননি বলে এনারা তা পারবেন না সেটা বলা চলে না।
গ্রামগুলোতে যে রাজনীতির বীজ বপন করা হচ্ছে তাতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ সম্প্রীতি, শান্তি। গণতন্ত্রের যে বিকৃতরূপ গ্রামে গ্রামে বপন করা হচ্ছে তাতে সুখকর কোন ফল ধরবে না। চিরায়ত গণসংস্কৃতির বদলে সেখানে তৈরি করা হচ্ছে ‘ভোটাভুটি’ সংস্কৃতি। দেশের বিদগ্ধ-জ্ঞানী ব্যক্তিরা এবং বিদেশি ডেলিগেটরা যাকে বলে গণতন্ত্র সেটা গণমানুষের কাছে ‘ভোটাভুটি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। ভাল গণতন্ত্র মানে তারা বোঝে ‘ভাল ভোটাভুটি’। ভোটাভুটি ভালমন্দ যাই হোক প্রতিবার এতে কম করে হলেও শ দেড়েক করে মানুষ মারা যায়। ৩৭
মানুষ এখন সম্পূর্ণরূপে নিঃরাজনীতিকৃত, দেশের এই পরিস্থিতিকে তারা নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছে। মানুষ রাজনীতির কথা শুনতে চায় না, আত্মরক্ষার শ্রমে সবাই ব্যস্ত কারণ মানুষ জানে দুঃখে, দারিদ্র্যে কেউ তাদের সাহায্য করবে না, তাদের দারিদ্র্য নিয়েও ব্যবসা করা হয়, এটাও তারা জানে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তরা অর্থ তৈরি করছে দিনে রাতে, তারাও জানে না এই সুযোগ কত দিন থাকবে, তাই তারা বাড়ি বানাচ্ছে দেশে-বিদেশে অনেক, পুঁজি খাটছে বিশে^র অনেক দেশে। কেবল শহর, গ্রামের কোটি কোটি মানুষ কর্মক্লান্ত, হতাশ, ভগ্নহৃদয় নিয়ে কালাতিপাত করছে। স্বল্পকাল পূর্বের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কোন কিছুই আর তাদের উজ্জীবিত করে না। ছাত্র রাজনীতিতেও নেই আশার আলো, ছাত্ররা কোন না কোন নষ্ট রাজনৈতিক দলের লেজ হয়ে থাকতেই পছন্দ করছে। তাদের নেই কোন চেতনা, নেই দেশ বা জাতির চিন্তা, তারা কেবল প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, রাজনীতি হচ্ছে তার একটা উপায় মাত্র। পুঁজি বাজারেও থাকে সুড়ঙ্গ সেই পথে কেউ কেউ উঠে যাচ্ছে উন্নতির পথে কিন্তু বেশির ভাগই পড়ে থাকছে হতাশাকে সঙ্গী করে। ‘প্রগতিরহিত, বিবেকহীন মানুষদের পৈশাচিক শাসনে মানুষ দিশেহারা। আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘ স্বার্থলোভী চরিত্রহীন রাজনীতিকেরা ও স্বার্থলোভী ধনিকেরা যেমন আজ সমাজপ্রগতির সকল পথ বন্ধ করে দিয়ে কেবল শ্রেণিস্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত, তেমনিই সুবিধালোভী বুদ্ধিজীবীরাও আজ মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে কেবল শাসক-শোষকের উচ্ছিষ্ট লাভের আশায় লালায়িত। ব্যধিগ্রস্ত বারবণিতাদের মতো তাদের মন শুকিয়ে মরে গেছে-দেহ শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। ওই মন আজ সম্পূর্ণ বন্ধ্যা, ওতে আবাদ করতে চাইলে চেষ্টা ব্যর্থ হবে, ওতে ফসল ফলবে না, ফুল ফুটবে না, ফল ধরবে না। ওই মনে কোন প্রকার জীবন জিজ্ঞাসা, নীতি জিজ্ঞাসা, সৌন্দর্য জিজ্ঞাসা ও মূল্য জিজ্ঞাসা যেন আজ অবশিষ্ট নেই।’ ৩৮ দেশের মানুষ সব সময় দুভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, কখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ, কখনো মৌলবাদী-অমৌলবাদী। কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই সব সময় বলতে চায় এর বিপরীতে ভারত বিরোধীতাকে পুরনো রোগে পরিণত করেছে আরেক পক্ষ। ৩৯ এর মাঝে গণতান্ত্রিক চেতনা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
প্রচার মাধ্যমসমূহ এখন পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী, তারাই গণচিন্তা তৈরি করছে। মানুষ নিজের মত করে ভাবতে পারছে না। সারা দিন মানুষের সামনে থাকছে কোন না কোন সংবাদ মাধ্যম, মানুষকে আর কষ্ট করে চিন্তা করতে হয় না, চিন্তা ওরাই করে দিচ্ছে তবে সেটা ওদের মত করেই দিচ্ছে-এটুকু যা তফাৎ। গণমানুষের কথা বলবে সে ধরণের পত্রিকা, মিডিয়া নেই বলা যায়। অন্যদিকে বাম ঘরানার বা বাম পত্রিকাগুলো মান্ধাতার আমলের মত করে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ফলে সেসবের দিকে মানুষকে আগ্রতী দেখা যাচ্ছে না। গণতন্ত্রকে তারা কেউই একটা পরিকল্পিত রাজনৈতিক চেতনা রূপে গড়ে উঠতে দিচ্ছে না, গণতন্ত্র যেন একটা স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুমিরের ছানা যেমন জন্ম মাত্রই সাঁতার জানে তেমনি বাংলাদেশের নেতা ও জনগণ সবাই জন্মমাত্রই গণতন্ত্র জানে, তাদের শেখার বা শেখানোর দরকার নেই। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও তৎকালীন দলগুলোর যে দেশপ্রেম ছিল এখন তা দুর্লভ হয়ে পড়েছে। উন্নত চরিত্র বৈশিষ্ট্য এখন কোন দলেই দেখা যায় না। দেশভাগের পরে পাকিস্তানের রাজনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে বাংলাদেশের রাজনীতিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। নৈতিকতার প্রশ্নে কোন দলই জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। ৪০
’৮০-র দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। রাজনীতি পরিণত হয়েছে আত্মোন্নতির অবাধ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে। ‘১৯৮০-র দশক থেকে, বলা যায় ‘মৌলবাদ’ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা থেকে, পৃথিবীব্যাপী রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কথিত বিজ্ঞানপন্থিরা আদর্শগত সঙ্কটে পড়েছেন এবং কথিত ধর্মপন্থিরা পুনরুজ্জীবিত হচ্ছেন।’ ৪১ তথাকথিত আন্দোলনকারীরা বুঝতে চাচ্ছেন না যে, একবিংশ শতাব্দীতে দুর্বল দেশগুলোর ওপর প্রধান আঘাত মৌলবাদীদের কাছ থেকে আসে না, আসে সা¤্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে। মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তারা মূলত ঘুমন্ত ভালুককে জাগিয়ে তোলেন। সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার জন্য জীবন বিধান চায়। এক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ধারণা খুবই অপূর্ণ বলে লেখক মনে করেন। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ-এগুলো কল্পিত, অভিপ্রেত, অভীষ্ট, কাম্য; বাস্তব নয়। আদর্শ হল একটা কল্পিত বাস্তব যেখানে মানুষ উপনীত হতে চায়। ৪২ আদর্শহীনতার এই যুগে মানুষের সামনে কোন আদর্শ নেই, সেই শূন্যস্থান পূরণ করা হচ্ছে ভ্রান্ত বিশ^াস দ্বারা। সমাজতন্ত্র বা গণতন্ত্রের ধারণাও মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। আদর্শগত শূন্যতার এই যুগে মানুষকে ধর্মীয় বিরোধে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। ‘ধর্ম নিয়ে, কিংবা আস্তিকতা-নাস্তিকতা নিয়ে যে বিরোধ এখন দেখা যাচ্ছে, তার মীমাংসা কি একপক্ষের চিরবিলোপ ও অপরপক্ষের চিরবিজয়ের দ্বারা হবে?’ ৪৩ লেখক বলেন, ধর্মরিপেক্ষতাবাদীরা শূন্যবাদী। তাদের প্রচেষ্টা কোন পরিণতি পাবে না। বাস্তবতা বর্তমানে এমন দাঁড়িয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাও ধর্মকে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছয়দফা আন্দোলন ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের জন্ম হয়। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রস্তুতি যথেষ্ট ছিল না। এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ও জনমানসে লক্ষ্য-আদর্শ অর্থে যে শৃঙ্খলা ছিল তাও বিনষ্ট হল, এই শূন্যতাকে কোন একটি আদর্শ দিয়ে পূরণ করা হয়নি। ইতিহাস অনুশীলনের কোন প্রচেষ্টাই দেখা যায়নি। ৪৪ নিজ নিজ দলীয় ও ব্যক্তিক স্বার্থই সদা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। ইতিহাস বিকৃত হয়েছে, সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিতে ইতিহাসকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রথম বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা ও তাজউদ্দীনের অবদানকে অস্বীকারের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। কী হত যদি তাজউদ্দীনও ২৫ মার্চ রাতে বন্দীত্ব বরণ করতেন বা তিনি প্রধানমšী¿ না হয়ে মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হতেন? প্রবাসী সরকার ও তৎকালীন রাজনীতির জটিলতাকে না বুঝবার প্রবণতা যুদ্ধপরবর্তী দেশের জন্যে হানিকর হয়েছে। তাজউদ্দীনকে প্রতিদ্বন্দ্বি ভেবে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটা যেন হ্যামলেটকে বাদ দিয়ে ‘হ্যামলেট’ নাটক উপস্থাপন করা। ৪৫ লিজে-, ভাবমূর্তি নির্ভরতার রাজনীতি অখ- ভারতের শুরু থেকেই দেখা যায়, আওয়ামী লীগও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ষাটের দশক থেকেই .. ভাবমূর্তিকে প্রধান করে ফেলা হয়েছিল এবং অর্ন্তদলীয় গণতন্ত্রের কোন প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। ... এই রীতি গণতন্ত্রের পরিপন্থী।’ ৪৬ বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিদ্যমান কোন দলের পক্ষেই আর গণতন্ত্র নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ৪৭
অদ্যাবধি বাংলাদেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবি সমাজে তিনটি প্রধান ধারা দেখা যাচ্ছে; লেখক ও শিল্পীদের একটি ধারায় দেখা যায় ভারতীয় সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ, অপর একটি ধারাতে দেখা যায় ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে, দেশ-কালের চেতনাকে গুরুত্ব না দিয়ে মধ্যযুগের মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সংস্কৃতিতে নিজেদের সংস্কৃতির উৎস সন্ধান। এর বাইরে আর একটি শক্তিশালী ধারা রয়েছে যারা ইউরো-মার্কিন আধিপত্যবাদীদের তাঁবেদার হয়ে দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেন। এই তিন ধারার বাইরে যে দেশ-কাল সচেতন ধারাটি রয়েছে তাঁদের কোন শক্ত অবস্থান নেই এবং তারা শতধা বিভক্ত, নিজস্ব চিন্তা দ্বারা তারা জনতাকে প্রভাবিত করতে পারেন না।
পাঁচ.
‘ বাংলাদেশে ভাল নেতৃত্বের অভাব কেন’ প্রবন্ধটি আবুল কাসেম ফজলুল হকের ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। একটি দেশকে গড়ে তোলার জন্য ভালো নেতৃত্বের বিকল্প নেই কিগুÍ যুগ যুগের প্রচেষ্টাতেও বাঙালিরা ভাল নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারছে না কেন? এটা একটা বড় প্রশ্ন। লেখক বলেন, ‘ বাংলাদেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতার ও কর্মীর এবং প্রতিটি সাধারণ মানুষের আজ দুটি ব্যাপার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে উপলব্ধি করা দরকার: এক. মহৎ নেতৃত্বের গুণাবলি, চরিত্রবল, সর্বজনীন কল্যাণ প্রয়াস, অধ্যবসায় , দূরদর্শীতা, উচ্চাকাক্সক্ষা, সাহস, প্রজ্ঞা, শ্রদ্ধাযোগ্য ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি জন্মগতভাবে কেউ নিয়ে আসে না, সাধনা ও সংগ্রামের দ্বারা অর্জন করতে হয়;
দুই. কোন ব্যক্তি নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনের জন্য প্রাণান্ত সাধনা ও সংগ্রাম করলেও তাঁর সাধনা ও সংগ্রাম জনসমর্থনের অভাবে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে; কারণ মহৎ নেতৃতের সফল আত্মপ্রকাশের পেছনে জনগণেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়, জনগণ নিষ্ক্রিয় থাকলে কিছুই হয় না।’ ৪৮ জনগণ ও সময়ই নেতৃত্ব তৈরি করে। বার্টা- রাসেল বলেন, জনগণ সে ধরণেরই নেতা পায় জনগণের যোগ্য যেমন। বাক্যটিকে আপেক্ষিক বা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করলেও এর তাৎপর্যকে অস্বীকার করা যায় না। যুগে যুগে বাঙালিরা অনেক সংগ্রাম করেছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে কিন্তু সৎ নেতা বেশি তৈরি করতে পারেনি। কেউ কেউ বড় হয়ে উঠছিলেন কখন কখন, কিন্তু মহত্ব তাঁরা বেশি সময় ধরে রাখতে পারেননি হয় তিনি নিজেই নেমে এসেছেন বা তাঁকে নামিয়ে আনা হয়েছে। বাঙালিরা কোট শ্যুট পড়ে বেশিক্ষণ থাকতে অভ্যস্ত নন।
‘বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে সমাজের স্তরে স্তরে যারা বেশি জবরদস্তিপরায়ণ, বেশি জুলুমবাজ, বেশি মিথ্যাচারী, প্রবলভাবে ক্ষমতালিপ্সু ও সম্পদলিপ্সু কেবল তারাই নেতা হন?’ ৪৯ ‘সাধারণত যারা প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে নেতিবাচক বক্তব্য উগ্রতার সঙ্গে উচ্ছ্বাসপূর্ণ ভঙ্গিতে ফুসফুসের শক্তি প্রদর্শন করে বলতে পারেন, বাঙালি সমাজে তারাই জনপ্রিয় নেতা হন। যারা জনপ্রিয় নেতা হন তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনমতের উত্থান-পতনের তালে তালে নিজের মত পরিবর্তন করে জনগণের উত্তেজনার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন।’ ৫০ হুমায়ুন আজাদ ‘রাজনীতিবিদগণ’ কবিতায় বলেছেন-নেতা মঞ্চে আরোহণ করলে-অন্ধ হয়ে আসে দু চোখ, চর পড়ে নদীতে, ছাইয়ে ঢেকে যায় ধানখেত, মনে হয় চিরকাল খুঁড়েছি কেবল কবর আর উঠে আসে কেবল খুলি, পোকা জন্মে আ¤্র ফলে, প’চে ওঠে পাকা ধান, পঙ্গপালে ছেয়ে যায় সবুজ মাঠ- ডাল থেকে গোঙিয়ে লুটিয়ে পড়ে ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল, আর্তনাদ করে বাঁশি যখন ওঠেন মঞ্চে রাজনীতিবিদগণ। ৫১
নেতৃত্বের এই রূপ বাঙালি হয়তো কোনদিন দেখেনি।
সহজাত না হলেও মানুষের মধ্যে ভাল-মন্দ উভয় গুণই দেখা যায়। মানুষ বড় হতে চায়, অমর হতে চায়, চায় খ্যাতি, ধন, ক্ষমতা-এসব কামনা পূরণ করতে মানুষ কখন কখন বক্র পথ গ্রহণ করে। সাধনা, দীর্ঘ প্রতীক্ষা বা কঠোর শ্রমের পথ পরিহার করে সংক্ষিপ্ত পথের সন্ধান করেন অনেকে, রাজনীতি সেই সংক্ষিপ্ত একটি পথ। বার্টান্ড রাসেল বলেন, ‘ আদর্শ পরায়নতার নামে যা চলছে, তার অধিকাংশই হয় ছদ্ম ঘৃণা, না-হয় ছদ্ম ক্ষমতানুরাগ। বিপুল জনসাধারণকে যখন আপনারা কোন আদর্শের নামে আন্দোলিত হতে দেখেন, তখন আপনাদের কর্তব্য, একটু গভীরে দৃষ্টি দিয়ে নিজেদের অন্তরকে জিজ্ঞাসা করা: তাদের প্রেরণার পেছনে ক্রিয়াশীল প্রকৃত কারণটি কী? এসত্ত্বেও এতই আকর্ষণ যে, তার মুখোশ দেখলেই মানুষ তার পেছনে ধাবিত হয়।’ ৫২
ড. জেকিল ও মি.হাইডের মত মানুষেরও রয়েছে দুটি সত্ত্বা, এর একটি অন্ধকারের অন্যটি আলোর। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে অন্ধকারদিকটিই বেশি করে প্রকাশিত হচ্ছে। ভাল ভাল মানবীয় গুণাবলিগুলো নষ্টদের ভ-ামী ও ব্যবহারের কারণে নষ্ট হতে বসেছে। ‘প্রত্যেক জনসমষ্টিতেই অধিকাংশ মানুষ থাকে অনুসারীর ভূমিকায়। কে বা কারা নেতা হবেন, নেতাদের চরিত্র কেমন হবে, তা অনেকাংশে নির্ধারিত হয় এই অনুসারিদের দ্বারা। নেতৃত্ব গঠনে অনুসারীরাও কাজ করে-কেউ হীনস্বার্থে , কেউ মহৎ স্বার্থে। তার ফলে ভাল নেতৃত্ব সৃষ্টির সম্ভাবনা আরো জটিল হয়ে ওঠে। কোন নেতা বা মন্ত্রীকে আপনার এলাকায় এলেই দেখতে পাবেন তার অনুসারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও দাপাদাপি, নেতা তাদের তুষ্ট করেন নানা উপায়ে, ফলে অনুসারীরা কামনা করে আরো বেশি, আরো সুবিধাভোগী অনুসারী জড়ো হয় দিনকে দিন। এভাবে ভাল নেতাও বিপথগামী হয়ে পড়েন।’ হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘বাঙালি: এক রুগ্ন জনগোষ্ঠী’ প্রবন্ধে বাঙালিদের যে চারিত্রিক দুর্বলতার দিক তুলে ধরেছেন সেটা সত্য হলে এখানে কোন চিন্তাই আপাত দাঁড়ানোর কোন সম্ভাবনা নেই। ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ, হুমায়ুন আজাদ।‘অনুকৃত বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান-প্রজ্ঞা দিয়ে এ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত তথাকথিত স্বাধীন দেশগুলোর নায়কেরা অতি দ্রুত ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর আদলে দেশ রচনার ও রাষ্ট্র সাজানোর দিবা স্বপ্ন দেখতে থাকে-কাল ও সাধ্যের কথা বিস্মৃত হয়েই।..কিন্তু ঐতিহ্য ছিল না বলে স্বাভাবিক প্রতিবেশ না পেয়ে সবকিছুই বিকৃতির ও বিশৃঙ্খলার শিকার হয়।’ ৫৩
‘জনসাধারণের দিক থেকে যেমন, নেতৃত্বের দিক থেকেও তেমনি সমস্যাটির বিচার সমান গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ শাসোনোত্তর গত প্রায় চার দশক ধরে আমাদের দেশে রাজনীতি ক্ষেত্রে যে সঙ্কট বিরাজ করছে তার জন্য প্রধাণত রাজনৈতিক নেতারা এবং রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী। তাঁরা বারবার জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণামূলক আচরণ করেন এবং তার ফলে তাঁরা ক্ষমতায় থাকতে পারেন না-সেনাবাহিনীর লোকদের রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দেন। কোন সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যজোট গঠনের সময় তাঁরা যে ন্যূনতম কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তার প্রতিও তাঁরা কখনো বিশ^স্ত থাকেন না। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রণ্ট থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত এ দেশে যত ঐক্যজোট গঠিত হয়েছে, সেগুলোর পরিণতির দিকে তাকালেই এই বিশ^াস ভঙ্গের বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদেশে ভালো রাজনৈতিক দল ও ভালো নেতৃত্ব গড়ে না ওঠার নানা কারণের মধ্যে একটা বড় কারণ বিপরীতমুখী আদর্শের ঘোষণা দানকারী রাজনৈতিক দলসমূহের এ ধরণের ন্যূনতম কর্মসূচিভিত্তিক ঐক্যজোট গঠনের ঐতিহ্য।’ ৫৪
ভাল নেতা হবার কোন সহজ পথ নেই আবার আছেও। ভাল নেতাকে ক্ষমতা ও অর্থের লোভ সংবরণ করতে হবে। নিজের লক্ষ্যের দিকে নজর সদা স্থির রাখতে হবে। আসবে প্রলোভন, ভয়, চাটুকারের দল-এসবকে অতিক্রম করতে পারবেন যিনি তিনিই হবেন ভাল নেতা কিন্তু আমাদের নেতারা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই রাজনীতিতে আসেন যাদের সৎ উদ্দেশ্য ছিল তারাও কোন এক সময় আর সততার ভার বহন করতে পারেন না তাই তারা ড. ফস্টাসের মত আত্মাকে বিক্রি করে দেন। ব্যক্তিগত ও দলগত চরিত্র উন্নয়নের কোন প্রচেষ্টাই কার মধ্যে দেখা যায় না। ‘মানুষের (ব্যক্তি ও সমষ্টির) আচরণকে শুভকর লক্ষ্যে পরিচালনা করার শক্তি তার নিজের ( ব্যক্তি ও সমষ্টির) ও তার পরিবেশের মধ্যেই অন্তর্নিহিত থাকে। কোন সমাজে নেতৃত্বকারী, নেতৃত্বাভিলাষী ও নেতৃত্বানুসারী লোকেরা কীভাবে নিজেদের সেই শক্তিকে কাজে লাগায় তার উপরই নির্ভর করে সেই সমাজের ভালো-মন্দ, উন্নতি-অবনতি, মঙ্গল-অমঙ্গল।’ ৫৫
অবিমিশ্র ভাল বা মন্দ কোন সমাজেই নেই, কেবল দরকার ভালর আধিপত্য, সে জন্য গণসংস্কৃতির মান উন্নয়ন করা দরকার, বাঙালিরা সহ¯্র সহ¯্র বছর সামন্তিয় ধ্যান ধারণার মধ্যে কালাতিপাত করেছে, বীরপূজা, রাজাপূজা, সেই সাথে দারিদ্র্য, কুসংস্কার সর্বদাই ছিল তার সঙ্গী। নীহাররঞ্জনের যে হাজার বছরের বাঙালি বা রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায়ের যে বাঙালি, রমেশচন্দ্র সেনের বাঙালি তারা কেউই ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত ছিল না আর সহ¯্র বছরে কেউ তাদের উন্নত সংস্কৃতির শিক্ষাও দেয়নি। ’৫২ ও ৬৯ এর আন্দোলন ও অভ্যুত্থানেই তারা প্রথম ভিন্ন ধরণের সংস্কৃতির পরিচয় পেয়েছিল, সেই সঙ্গে তারা জেনেছিল ইউরোপীয় মানবতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রগতিশীলতার পরিচয়, কিন্তু তাদের সেই আকাক্সক্ষা ব্যর্থ হয়েছে কারণ যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা নিজেরা সেই সব উন্নত চিন্তাকে ধারণ করতে পারেননি। অমরত্বের আশায় তারা দেশ ও জাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
অদ্যাবধি সৎ, যোগ্য নেতা বলতে আমরা বুঝি-উঁচু বংশ, অনেক অর্থের মালিক, অনেক দিক দিয়েই যিনি নামী -দামী। এই গণসংস্কৃতির জন্যে দরকার বৌদ্ধিক জাগরণ, উনিশ-বিশ শতকের জাগরণে জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছিল না, কোন কালেই হয়নি। জনগণকে তৈরি করে তোলা তাই প্রগতিশীল শক্তিগুলোরই দায়িত।া
নীতিজ্ঞানের শিক্ষা কোন দলের অভ্যন্তরেই দেখা যায় না, প্রগতিশীল আন্দোলনে চলতি দর্শন চর্চার বাইরে কোন ধরণের নীতির চর্চা দেখা যায় না। দলের অভ্যন্তরে নৈতিক অনুশীলন না থাকলে কোন না কোন সময়ে অনৈতিক, পতিত মানুষেরা আধিপত্য করার সুযোগ পায়। দলের সংহতি, শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নানাবিধ নীতি নৈতিকতার অনুশীলন অত্যাবশ্যক, কেবল যান্ত্রিক রাজনৈতিক বিষয়ালোচনা মনকে স্থিরতা প্রদান করতে পারে না। এই অনুশীলন হবে অবশ্যই বিজ্ঞানানুসারী, বস্তুবাদভিত্তিক, দ্বন্দ্বদর্শন অনুসারী। নৈতিকতাকে গুরুত্ব না দিলে যে কোন তত্ত্বই ভেঙে পড়বে, কেননা সংবিধান, আইন, তত্ত্ব-এসব মানুষই তৈরি করে মানুষই ভাঙে, কেবল কাঠামোর মধ্যে ফেলে দিলে সব আপনা আপনি চলতে থাকবে - এটি কোন সঠিক চিন্তা নয়। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘চিত্তশুদ্ধি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘চিত্তশুদ্ধি থাকিলে সকল মতই শুদ্ধ। চিত্তশুদ্ধির অভাবে সকল মতই অশুদ্ধ। যাহার চিত্তশুদ্ধি নাই তাহার কোনো ধর্ম নাই।’ এই কথার তাৎপর্য এটাই যে, উপযুক্ত মননশীলতা ব্যতীত যে কোন তত্ত্বই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে তা না হলে সমাজতান্ত্রিক বিশ^ পুঁজিবাদের তুলনায় উত্তম আর্থসামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করে দেখিয়েও কেন ভেঙে পড়ল? কারণ সহ¯্রটি থাকলেও মানুষের দানবীয় কামনাই মূলত এর প্রধান কারণ।
দলের লক্ষ্যকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে নেতা কর্মীদের মনোজগতের দিকেও তাকাতে হবে, ‘মনোজগতের অবস্থাকে বিবেচনায় না ধরে, বৃত্তি-প্রবৃত্তি, কামনা-বাসনার ও আশা-আকাক্সক্ষার পরিচয় না নিয়ে, ¯œায়ুম-লীর ক্রিয়া কলাপের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা না করে আর্থ -সামাজিক-রাষ্ট্রিক সমস্যাবলির শুধু প্রকাশরূপকে আশ্রয় করে সমাধান খুঁজলে কখনো কোনো কার্যকর দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পাওয়া যায় না। আমাদের দেশের গত অর্ধশতাব্দীর ঘটনাবলিই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।’ ৫৬
গবেষক অনুপম সেন বলেন, ‘নৃতাত্ত্বিক অর্থে বাঙালি জাতির উন্মেষ ঘটে আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে কিন্তু যথার্থ জাতি হিসেবে বাঙালির পদযাত্রা শুরু হয়েছিল প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উন্মেষের মাধ্যমে কিন্তু এই জাতি সত্তা ছিল অসচেতন। সেদিনের বাঙালি নিজের পরিচয় খুঁজত পরিবারের মধ্যে, বর্ণের মধ্যে ও গ্রামে’। ৫৭ একালেও বাঙালিরা তাঁদের আত্মপরিচয় খুঁজে পাচ্ছে না, বাঙালিত্বকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে বাধা দিচ্ছে যেমন একটি গোষ্ঠী তেমনি আর একটি গোষ্ঠী তাঁকে আত্মকেন্দ্রীক স্বার্থবুদ্ধির কূট বুদ্ধি প্রদান করছে। এর থেকে বেরিয়ে আসবার পথ অবশ্যই খুঁজতে হবে তাঁদের। মূলত উনিশ শতকের পূর্বে বাঙালির ধর্মে-সাহিত্যে-রাজনীতিতে কোন সর্ববঙ্গীয় চরিত্র ছিল না। আড়াই হাজার বছরের পরস্পর বিচ্ছিন্নতা ও পরাধীনতা বাঙালিকে কোন দিক দিয়েই দৃঢ় চরিত্র প্রদান করেনি। এটিও জাতিগত একটি দুর্বলতা, দুর্বলতা সৃষ্টিশীলতা বিনষ্টের কারণ হয়।
রাজনীতির গতিনির্ধারণে সংবাদপত্রের ভূমিকা এ বিষয়ে লেখক নানা স্থানে আলোচনা করলেও ‘ প্রাচুর্যে রিক্ততা’ গ্রন্থে ‘ইতিহাসের গতি নির্ধারণে সংবাদপত্র’ প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রবন্ধটিকে তিনি পাঁচটি অংশে বিভক্ত করে বক্তব্য প্রাঞ্জল করেছেন। উপশিরোনামগুলো হল: ইতিহাসের ধারায় জন্তু-জানোয়ার ও মানুষ, দুই. কয়েকটি পত্রিকার ঐতিহাসিক ভূমিকা তিন. রাজনীতির গতি নির্ধারণে সংবাদপত্র চার. বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরনির্ভরতা ও সংবাদপত্র পাঁচ. বিকার ও প্রতিকার
উপশিরোনামসমূহই লেখকের বক্তব্যকে স্পষ্ট করেছে। ইতিহাস সৃষ্টিতে পত্রিকার ভূমিকা অপরিসীম। এক সময় ‘আজাদ’ পত্রিকা পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরও সংগঠিত করতে অসাধারণ অবদান রেখেছে। মানিক মিয়ার ‘ইত্তেফাক’ ৬-দফা কর্মসূচিকে জনপ্রিয় করেছে। পত্রিকা দুটি পরিস্থিতির দাস না হয়ে পরিস্থিতিকেই দাসে পরিণত করেছে। কিন্তু এর বিপরীতে মাওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’ ও জাসদের ‘গণকণ্ঠ’ সরকার উৎখাত করা ও বিক্ষোভ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল কিন্তু কোন গঠনমূলক চিন্তা সৃষ্টি করতে পারেনি কেবল পরিস্থিতিতে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ১৯৭০, ৮০ ও ৯০ এর দশকের দিকে বিচিত্রা, সন্ধানী, রোববার নয়াপদধ্বনি প্রভৃতি পত্রিকা নানাভাবে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এর মধ্যে বিচিত্রা নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিচিত্রায় যুক্তছিলেন তৎকালীন প্রখ্যাত সব লেখক ও চিন্তকগণ, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ, কাজী নূরুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, আনু মাহমুদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জাহানারা ইমাম, এনায়েতুল্লাহ খান, হুমায়ুন আজদ প্রমুখ। পত্রিকাটি দুর্নীতি বিরোধী প্রচারণায় দেশ কাঁপিয়েছিল, সব কিছুকেই তাঁরা উপস্থাপন করেছিলেন কালিমালিপ্ত করে। দেশের সব কদর্যতাকে খুঁজে খুঁজে বের করে সব কিছুকেই আক্রমণ করেছিল অত্যন্ত কঠোরতার সাথে। ‘বিচিত্রার নিরন্তর নর্ঞ্থক প্রচারের ফলে জনমনে জাতীয় হীনমন্যতাবোধ দেখা দেয় যা পরে আরো মারাত্মক হয়েছে। বিচারপতি সাত্তার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি থাকাকালে চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ‘বিচিত্রা’ সেনাপতি এরশাদকে প্রচার দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছিল। অধ্যাপক আবু মাহমুদ তখন দৈনিক প্রত্রিকায় দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে এরশাদকে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন।’ ৫৮
জামাত তৎকালে কোন উল্লেখযোগ্য শক্তি ছিল না কিন্তু বিচিত্রার পক্ষ থেকে জামাতকে মৌলবাদি বলে এমন রূঢ়তার সঙ্গে প্রচার চালায় যে অচিরেই জামাত দাঁড়িয়ে যেতে থাকে আর জামাতও পত্রিকাটির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়নি! আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জামাতকে খাড়া করাই ছিল বিচিত্রার অঘোষিত লক্ষ্য। ৫৯ মূলত সেই সময়টি ছিল গণমনে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা প্রদান করার সময় কিন্তু পত্রিকাটি জনমনকে এসব থেকে সরিয়ে উগ্র নারীবাদী আন্দোলন ও মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে নিবদ্ধ করে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়কেই পত্রিকাটি বিনোদনের বিষয়ে পরিণত করেছে আর গুরুত্বহীন অনেক বিষয় দিয়ে জনগণকে মাতিয়েছে। উগ্রতা, ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন, লক্ষ্যহীন বিতর্ক জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে। ‘ জনগণের সামনে সম্মিলিত জীবনযাত্রার কোন বিজ্ঞান সম্মত পড়ফব ড়ভ বঃযরপং নেই বাংলাদেশে। গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রকে জনগণের সামনে জীবনদর্শন ও জীবনপদ্ধতি হিসেবে রূপ দেওয়া হয়নি..।
আজকের দিনে সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশের ও প্রগতির পথে মূল বাধা মৌলবাদীদের দিক থেকে আসে না, আসে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের দিক থেকে। তারাই কৌশলে ক্রমাগত মৌলবাদীদের উস্কানি দিয়ে সামনে আনে।..জামাত প্রতিপক্ষের আক্রমণকে আত্মবিকাশের জন্য লাভজনক মনে করে!’ ৬০
সম্ভাবনার সেই সময়ে কোন প্রগতিশীল পত্রিকাই গণচেতনাকে সংহত করেনি, পত্রিকাগুলো গতানুগতিকতার ধারাতেই গড়িয়েছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির ধারাকে সংশোািধত করার কোন প্রচেষ্টা করেনি কোন প্রত্রিকাই। রাজনীতি পুনর্গঠনের যে দাবি একবিংশ শতাব্দীতে বিশে^ গণমনে উত্থিত হয়েছিল তার মূর্তরূপ দিতে ব্যর্থ হয় পত্রিকাগুলো। পুঁজিপতিরা পত্রিকার আড়ালে এক দিকে যেমন আড়ালে থাকছে অন্য দিকে জনমনকে সর্বদাই কোন না কোন ইস্যু বা তুচ্ছ বিতর্কে ব্যস্ত রাখছে। জনগণের হয়ে চিন্তা করার, জনগণের দাবি তুলে ধরার এবং একবিংশ শতকে জনগণের আর্থ-সামাজিক –রাজনৈতিক অধিকারের রূপরেখো পরিচ্ছন্নভাবে তুলে ধরার মত কোন পত্রিকা নেই। বাম ঘরানার যে সব পত্রিকা রয়েছে তারা চলছে গতানুগতিক ধারায় তাতে জনমন আকৃষ্ট হয় না বা তাঁদের কথায় কর্ণপাত করার বিষয়ে ভাবেন না। সময়ের উপযোগীতা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির কথা বিবেচনায় রেখে শক্তিশালী গণমাধ্যম গড়ে তুলতে হবে প্রগতিশীল শক্তিগুলোকেই।
ছয়.
গণতন্ত্র ও নয়া গণতন্ত্র
‘আমাদের এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে এক মুহুর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না যে এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং সত্যিকার অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারন কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা তাঁদের সাহস, তাঁদের বিশ^াস, স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাঁদের নিমগ্নপ্রাণ, তাঁদের আত্মাহুতি, তাঁদের ত্যাগ, ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসূ হয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্যে রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষে মানুষকে শোষণ করবে না।আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি।’ ৬১
বাঙালি জাতি তার লক্ষ্য কতটা অর্জন করেছে? এতশীঘ্র একটি জাতি কী করে এত ত্যাগ, এত রক্তপাতের ইতিহাস ভুলে যেতে পারে। স্তালিন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পরে তাঁর দেশবাসীকে বলেছিলেন, ‘ এই ত্যাগ কখনো ভুলবে না।’ রাশানরা অল্প সময় পরেই সেই ত্যাগের ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে। কীসের আশায়, কেন তারা বিপ্লবের আদর্শকে ত্যাগ করেছে? তবুও তারা উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছে। বাঙালিরা কেন তাদের ইতিহাস ভুলে গেল তাদেরও কি দুকোটি প্রাণের আত্মাহুতির দরকার ছিল, নাকি তাদের স্বভাবই ভুলে যাওয়া, অস্বীকার করা, নষ্ট করা?
‘প্রাচুর্যে রিক্ততা’ গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে লেখক ‘বাংলাদেশের মূল দুই দুর্বলতা’র বিষয়ে বলেছেন। দুর্বলতা দুটির একটি হল অন্তর্গত দুর্বলতা অপরটি পারিপাশির্^ক দুর্বলতা। অন্তর্গত দুর্বলতা মূলত নেতৃত্বের দুর্বলতা ও গণচেতনার দুর্বলতা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা বেশিদিন পূর্বে নয়-পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতকে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালির আত্ম পরিচয়ের সূত্র নির্মিত হয়েছে। এই আত্মপরিচয় ছিল প্রকৃতপক্ষে ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রিক, বাঙালির এই আত্মপরিচয় জাতীয়তাবাদে রূপ নেয় ’৫২ থেকে ’৬৯ এর দশকগুলোতে ভাষা-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তবে বাঙালির রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রধান করে উঠতে দেওয়া হয়নি কোন কালেই। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মিশ্র বা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র কোন পরিচয়ই প্রধান হয়ে ওঠেনি। নেতাদের চারিত্রিক দুর্বলতা ও অসৎ প্রবৃত্তি দ্বারা মানুষ বারবার বিভ্রান্ত হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয়তাবাদই ছিল দলগুলোর চালিকাশক্তি। ক্ষমতায় গিয়ে দেশ চালানোর রূপরেখা নির্মান করেনি কোন দলই, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র, গণদাবি সবই ছিল মৌখিক প্রতিশ্রতির বিষয়।
বামদের গণভিত্তি ছিল না কখনই, তারা সব সময়ই ছিল ভ্রান্ত, দেশ, রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে তাদেরও নেই কোন লিখিত আবেদন। কেবল ক্লাসিক্যাল মার্কসীয় চিন্তাকে সম্বল করে তারা বিপ্লব করতে চান, সব যেহেতু মার্কস, লেনিন, মাওসেঙ আগেই লিখে গিয়েছেন তাই তারা নতুন করে কিছু লিখতে চান না। ‘মাওলানা ভাসানী কমিউনিস্ট না হওয়া সত্ত্বেও কার্যক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের নেতায় পরিণত হন! মাওলানাকে লাল সালাম জানিয়ে এই পর্যায়ে কমিউনিস্টরা বিপ্লবের বিকাশ ঘটাবার যে প্রচেষ্টা করেন তার সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদী -লেনিনবাদী বিপ্লবী রাজনীতির নীতি ও কৌশলের কোনই সম্পর্ক ছিল না’। ৬২ মাওলানা ভাসানীর কৃষক শ্রমিকের প্রচুর সমর্থন ছিল কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতার আকাক্সক্ষা তাঁর ছিল না। ৬৩ এবং জনগণকে তিনি কোন নির্ধারিত লক্ষ্যে পরিচালিত করেননি। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি কথা বললেও পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করে তিনি ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ প্রচার করে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে মানুষকে বিভ্রান্ত করে দেন। অধিকন্তু বামপন্থি দলগুলো মাওলানা ভাসানীকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে; যে বামদের দিকে ভাসানীর পক্ষপাত ছিল এক সময় দেখা গেল তারাই মস্কো ও পিকিং পস্থি দু ধারায় বিভক্ত হয়ে গেল। ৬৪ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমান একদল চক্রান্তকারীর কবলে পতিত হন, তাঁদের প্ররোচণায় তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রীসভা থেকে অপসারণ করা হলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। এর পরবর্তীতে ’৭৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রান্তিকাল নেমে আসে। বড় বড় দলগুলো কেবল পুঁজিপতিদের একচ্ছত্র আধিপত্যের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ‘১৯৭২ সালের শুরু থেকেই বাংলাদেশ এই অবস্থায় পড়ে যায়। তিনি যুদ্ধে যাননি, .. যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেননি এবং পরে পক্ষপাতমুক্ত অবস্থানে থেকে বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব সম্পর্কে জানতে চাননি। তখন অন্যান্য দলের মধ্যেও, নবগঠিত জাসদের মধ্যেও, রাষ্ট্র ব্যাপারে সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচার বিবেচনা ছিল না।’ ৬৫ পরের দিনগুলোতে দলগুলোতে চালু হয় পরিবার তন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র। অর্ন্তদলীয় গণতন্ত্র কোন দলেই দেখা যায় না। ৬৬ আরোহী পদ্ধতির বদলে দলগুলো গ্রহণ করেছে-আপ্তবাক্য ও অবরোহি পদ্ধতি।
পাারিপাশির্^ক দুর্বলতা হল: বাংলাদেশের সব দিকই ঘিরে রয়েছে ভারত। স্বাধীনতার বছর না যেতেই ভারত ও হিন্দু বিদ্বেষকে রাজনীতির বিষয়ে পরিণত করা হল। তাজউদ্দীন সরকার যেসব দলকে দেশবিরোধী কার্যের জন্যে নিষিদ্ধ করেছিলেন পরের নেতারা সেসব দলকে পুনর্বাসন করে এবং ধর্মকে রাজনীতির নিয়ামকে পরিণত করা হয়।
সর্বশেষ সিভিল সোসাইটির সরকার আসার পর্বে চারদলীয় জোটের মেয়াদ শেষ হবার অব্যবহিত পূর্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ও বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মান্নান ভুঁইয়ার চারদিন ব্যাপী যে একান্ত বৈঠক হয়েছিল তাতে জলিল সাহেব তাঁর দলের ‘৩১-দফা’ থেকে একবিন্দু সরে আসেননি বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। সেই একত্রিশ দফা এখন কোথায়? অথচ এই সরকারই ’৬৬ সালে ঘরে ঘরে ৬-দফা পৌঁছে দিয়েছিল, দলগুলো এখন আর সেরকম কর্মসূচি নেয় না কেন? বোঝা গেল,ক্ষমতায় যাওয়ার পরে গণকর্মসূচির দরকার হয় না।
‘স্বদেশ চিন্তা সংঘ’ থেকে ২০০৫ সাল থেকে ২৮-দফা কর্মসূচি প্রদান করা হয়েছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ের ভিত্তিতে। ‘প্রাচুর্যে রিক্ততা’ গ্রন্থে আটাশ দফা কর্মসূচি অন্তর্ভক্ত করা হয়েছে। সমাজতন্ত্রের বিজয়ের কালে ইউরোপের অনেক দেশই সমাজতন্ত্র থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্যসমূহ অক্ষুণœ রেখেও তারা জনজীবনকে অনেকদিক থেকে সহনীয় করে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ২৮-দফাও সেরূপ একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের চিন্তাপ্রসূত কর্মসূচি। অনুপ সাদী সমাজতন্ত্রের ২৪ টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। ৬৭ দু-একটি ক্ষেত্র ব্যতীত ২৮ দফা ও ২৪ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব বলে মনে করার কারণ রয়েছে।
ঋাষাবিদগণ বলেন, সব চেয়ে ভাল শব্দগুলোই আগে নষ্ট হয়, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র শব্দ দুটিও আর পূর্বের মত আবেদন সৃষ্টি করে না। এ কারণে লেখক গণতন্ত্রের বদলে ‘নয়াগণতন্ত্র’ শব্দ ব্যবহরের পক্ষপাতী। নয়াগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় মাও সে তুঙের রাষ্ট্র চিন্তার প্রভাব লক্ষ্যনীয়, লেখক এটি নির্মাণে ইউরোপের কল্যানমূলক রাষ্ট্রের বিবেচনাকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। মাও সে তুঙ তাঁর ‘অন নিউ ডেমোক্রেসি’ রচনায় তাঁর যুক্তফ্রণ্ট ভিত্তিক ‘নয়া গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের ধারণা দিয়েছেন। ‘পুঁজিবাদকে সুসংহত করার পরিবর্তে মাও পরিকল্পিত এই বিপ্লবের প্রধানতম লক্ষ্যবস্তুই হবে পুঁজিবাদকে সুসংহত করার পরিবর্তে পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র-এর বিকল্প একটি আর্থ -সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা, যেটি সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথে এক অন্তর্বতীকালীন পর্যায় হিসেবেই গণ্য হবে।’ ৬৮ সাম্যবাদী আদর্শ মূলত মানুষের কল্পিত আদর্শ, সেটা এখনই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, তাই নয়াগণতন্ত্রকে গণ্য করতে হবে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হিসেবে ।
‘গণতন্ত্র ও নয়াগণতন্ত্র’ প্রবন্ধটিকে লেখক আটটি উপশিরোনামে বিভক্ত করেছেন:
১. বাাংলা ভাষায় গণতন্ত্র ২. যে গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশে আন্দোলন চালানো হচ্ছে ৩. পুঁজিবাদী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ৪. পুঁজিবাদী গণতন্ত্র ও কল্যাণ রাষ্ট্র ৫. নয়াগণতন্ত্র বা জনগণের গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক গণরাষ্ট্র ৬. নয়াগণতন্ত্রে নির্বাচন. নয়াগণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার ৭. জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিশ^ায়ন ৮. জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিশ^ায়ন
বাংলা ভাষায় গণতন্ত্র: বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম বাঁধা এটাই যে, বাংলা ভাষায় গণতন্ত্র চর্চা কখনই হয়নি। উনিশ বিশ শতকের বুদ্ধিজীবী, লেখক সমাজ সংস্কারকগণ সমাজের সংস্কার করেছেন, দেশের বিবিধ বিষয়াদিও আলোচনা করেছেন কিন্তু গণতন্ত্র নিয়ে কারই কোন আলোচনা দেখা যায় না। ‘এদেশ দীর্ঘকাল ইংরেজের শাসনাধীনে ছিল ইংরেজদের গণতন্ত্রের ভিত্তিতে গণতন্ত্রের কথা বলেন অনেকে কিন্তু নিজের দেশের বিবেচনায় কেমন হবে এর রূপ সেটা নিয়ে লেখেননি কেউই। এঅঞ্চলের নেতা রূপে যাঁদের আমরা চিনি-সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ, এম. এন, রায়, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী প্রমুখ জাতীয় জীবনে এঁদের অনেক অবদান থাকা সত্ত্বেও এঁদের কারো লেখা কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে গণতন্ত্র সম্পর্কে দেশকাল –উপযোগী সর্বাঙ্গীণ কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। আসলে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই, পূর্বশর্ত পূরণ না করেই এদেশে দীর্ঘ কাল ধরে লোকে গণতন্ত্র আশা করেছে!’ মৌখিক জ্ঞান সর্বদাই অনির্ভরশীল, রুশ, চিনা লেখাসমূহও এদেশের জনজীবনে বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি, ইউরোপ আমেরিকার পুস্তক তো আরো নয়; লিখিত প্রমাণের অভাবে ইতিহাসও পুরাণে পরিণত হয়, এর সুযোগ অনেকে অনেকভাবে নেয়, আর থাকে ভুল বোঝার সম্ভাবনা। ‘ভারতে মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বসু, জওহর লাল নেহেরু এবং আরো কোনো কোনো নেতা যেভাবে রাষ্ট্রের রূপ, রাষ্ট্র গঠন, জাতিগঠন, সমাজ গঠন, জীবন দর্শন ও জাতীয় সংস্কৃতির পরিকল্পিত বিকাশ নিয়ে চিন্তা করেছেন, পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে রাজনীতিবিদেরা তেমনটি করেননি।’ ন্যূনতম বৌদ্ধিক অর্জন ব্যতীত কী করে চর্চা করা সম্ভব গণতন্ত্রের মত জটিল একটি রাষ্ট্র দর্শন? আবুল কাসেম ফজলুল হক সর্বদা বলে এসেছেন যে, যে কোন দর্শন বা মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বাগ্রে দরকার বৌদ্ধিক জাগরণ বা নীতির চর্চা। নীতির অভাবে যে কোন উন্নত দর্শনই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। মধ্যযুগীয় চিন্তাকে পশ্চাতে ফেলে একদা জন্ম নিয়েছিল গণতন্ত্র, পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা। কিন্তু অনুন্নত দেশগুলোতে মানুষেরা এর কোনটির জন্যেই উপযুক্ত নয়। শিক্ষায় অনগ্রসরতা, আধুনিক ধ্যানধারণার অভাব, নৈতিক শিক্ষার অভাবে সব ধরণের উন্নত মতবাদই এখানে ব্যর্থ হয়ে যায়। জনগণের চেতনার মানকে একটি নির্দিষ্ট স্তরে উন্নীত না করে কোন মতবাদই প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না অন্যদিকে এই অবক্ষয়ের যুগে ফিরে আসছে মধ্যযুগীয় রক্ষণশীলেরা।
যে গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশে আন্দোলন চালানো হচ্ছে
দেশের গণতন্ত্র বলতে এখন চিন্তাবিদেরা বোঝেন-ক্ষমতায় যাওয়ার এক দফা এবং একটা ভাল ভোটাভুটি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা প্রভৃতি শক্তি ১৯৮০ ’র দশক থেকে জাতীয় সংসদের সদস্যদের গণতন্ত্র বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়ার কথা বলছেন! বাংলাদেশের রাজনীতি পরিচালিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি দ্বারা। পলাশির যুদ্ধের সমকালীন মুর্শিদাবাদের রাজনীতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের ঢাকার রাজনীতির কোনো কোনো দিক দিয়ে ভীষণ মিল পাওয়া যাচ্ছে। দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় আছে বিদেশি অর্থে লালিত এনজিও, সিভিল সোসাইটি, তাঁরা যে গণতন্ত্রের কথা বলেন তা দেশের পঁচানব্বই ভাগ মানুষের গণতন্ত্র নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে ‘লিবারাল ডেমোক্রেসি’র কথা বলে তা মূলত গণমানুষের গণতন্ত্র নয়। এই গণতন্ত্র পুঁজিবাদী-বিশ^ায়নবাদী গণতন্ত্র।
পুঁজিবাদী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র
ফরাসী বিপ্লব পুরোপুরি ব্যর্থ যায়নি, এ বিপ্লব সাহস যুগিয়েছিল পুরো পৃথিবীকে, এর ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয় রুশ বিপ্লব। সমাজতন্ত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ব্যক্তির সামাজিক গুণাবলির বিকাশে। পুঁজিপতিরা সমাজতন্ত্র থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ধনতন্ত্রকে নতুন করে সাজিয়ে নেয় কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো চিন্তাকে যুগোপযোগী না করার কারণে বিপণœ হয়ে পড়েছে। ‘মানুষের মনোজীবনের ও সৃজনসামর্থের প্রতি যথোচিত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পুঁজিবাদী শিবিরের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা গ্রহণ না করার ফল খারাপ হয়েছে। নিজেদের আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অহমিকা ক্ষতির কারণ হয়েছে। নীতি ও আইন অবলম্বন করা হয়েছে, কিন্তু মানুষের নৈতিকসত্তার স্বরূপ ও মনোজীবনের বাস্তবতাকে বিবেচনায় ধরা হয়নি। ..মার্কসবাদীরা মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন, মাও সেতুঙ্রে উক্তি ও লেখা অবলম্বন করেছেন, আরোহ পদ্ধতিকে বিবেচনার বাইরে রেখেছেন। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিতর্কের মতো যেসব বিতর্ক তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে সেগুলোর মীমাংসা তারা করতে পারেননি। ..উৎপাদনের ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রবর্তনের পুঁজিবাদী চিন্তকদের প্রধান দুটি আপত্তি ছিল এই যে, তাতে লোকের কাজ করার ইনসেনটিভ থাকবে না, এবং কমিউস্টি পার্টি আমলাতান্ত্রিক হয়ে উঠবে। সমাজতন্ত্রীরা এই আপত্তিতে গুরুত্ব দেয়নি। ফলে এক সময় সত্য সত্যই সঙ্কট দেখ দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার পর পুঁজিবাদী মহল থেকে ক্রমাগত বলা হয়েছে, মার্কসবাদকে কমিউনিস্টরা ধর্মে রূপান্তরিত করেছে।..যাঁরা এখনও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ নিয়ে সক্রিয় আছেন তাঁরা অনেকেই পুরাতন চিন্তাধারা ও পুরাতন অভ্যাসকেই অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরে আছেন।’
নয়াগণতন্ত্র বা জনগণের গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক গণরাষ্ট্র: ‘নয়াগণতন্ত্রে শ্রমিক, কৃষক, বৃহত্তর মধ্যবিত্ত ও জাতীয় ধনিকদের বাস্তবসম্মত স্বার্থ ও মর্যাদা রক্ষা করা হয়।.. আজকের বাস্তবতায় জনগণের গণতন্ত্রের বা নয়াগণতন্ত্রের বা গণতান্ত্রিক গণরাষ্ট্রের ধারণার মধ্যে অতীতের সমাজতন্ত্রের ধারণা ও অভিজ্ঞতাকে সমন্বিত করে নিতে হবে।..গত তিন দশকের মধ্যে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা পরাশক্তির হাতে চলে গেছে বা তুলে দেওয়া হয়েছে, এবং পুরাতন পরাজিত সব সংস্কার-বিশ^াসকে পরিকল্পিতভাবে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। ইতিহাসের গতি উল্টে ফেলা হয়েছে এবং সেই উল্টো গতি বেগবান আছে। গোটা পৃথিবী জুড়েই বইছে উল্টো হাওয়া। প্রগতিবাদী চিন্তা ও কর্মের ধারা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বাস্তবতার মধ্যে নয়াগণতন্ত্রের জন্য আমাদের চিন্তা ও কাজ করতে হবে। অতীতের দৃষ্টি নিয়ে বিমূর্ত আদশের জগতে বিচরণ করলে কোনো সুফল হবে না। নতুন বাস্তবতা বুঝে সম্মুখদৃষ্টি নিয়ে প্রগতির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য নয়াগণতন্ত্রের রূপ ও প্রকৃতি আমাদের উদ্ভাবন করে নিতে হবে। এর জন্য আমাদের অবলম্বন করতে হবে সদর্থক বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ।’
‘নয়াগণতন্ত্র হল শ্রমিক, কৃষক, নি¤œ-মধ্যবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও জাতীয় ধনিকদের অধিকার,মর্যাদা ও ন্যায় স্বার্থ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ, প্রগতিশীল অগ্রযাত্রার গণতন্ত্র। নয়াগণতন্ত্রেও জন্য গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে-রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে-পুনর্গঠিত, নবায়িত ও বিকাশশীল করতে হবে। নয়াগণতন্ত্রে বিদেশের দালালি করে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ করার তৎপরতা কঠোরভাবে বন্ধ রাখা হবে। এবং জাতির আত্মশক্তির উপর নির্ভর করে, জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা করে, নিজেদের প্রয়োজন ও সামর্থ অনুযায়ী বাইরের জগত থেকে গ্রহণ কওে উন্নতির উপায় করতে হবে।’ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রনীতির সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষানীতিরও আমূল সংস্কার করতে হবে। বৈচিত্রে বা বহুত্বে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে, তেমনি গুরুত্ব দিতে হবে ঐক্যে বা সমন্বয়ে।’
‘রাষ্ট্রের জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এর জন্য নয়াগণতান্ত্রিক আদশেরও দলকে প্রচুর জনসমর্থন অর্জন করতে হবে এবং সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাধিক্য নিয়ে ক্ষমতায় যেতে হবে।..ক্ষমতায় যাওয়ার আগে ও পরে আদর্শগত, সাংগঠনিক এবং কর্মসূচি ও কর্মনীতিগত সবরকম প্রস্তুতি ও কাজ সম্পন্ন করে কওে পথ চলতে হবে। জনগণের নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হবে নয়াগণতান্ত্রিক আদর্শের জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল ও তার সম্পূরক সাংস্কৃতিক সংগঠন।’
‘দল কাজ করবে সর্বজনীন কল্যাণ-দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে। ..নয়াগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দলই হবে কেন্দ্রীয় শক্তি। সরকারের চেয়ে দলের গুরুত্ব বেশি বৈ কম হবে না। দলই থাকবে মূলে, তার উপর সরকার। দল হবে মূল পরিচালক শক্তি, সরকার হবে উপরের ধাপে –নির্বাহী শক্তি।’
‘ ব্যক্তি, দল ও সরকারের সম্পর্কের মধ্যে এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তির সামাজিক কর্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে।..দলীয় নেতৃত্বে ও সরকারি ক্ষমতায় বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার, স্বজনপ্রীতি, পরিবারতন্ত্র, দলীয়করণ ইত্যাদির কোনো সুযোগ রাখা হবে না।’
‘দল লিখিত সংবিধান অবলম্বন করে কাজ করবে। দলের ঘোষণাপত্র ও সংবিধান এবং রাষ্ট্রের সংবিধান সব সময় জনগণের মধ্যে প্রচার করা হবে।’
‘রাষ্ট্রের বিভিন্ন আদর্শের দলের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে তা দলের সংবিধানে এবং রাষ্ট্রের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বর্ণিত রাখা হবে।..দলকে চলতে হবে অন্যান্য দলের সঙ্গে সুস্থ স্বাভাবিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। দল একবার ক্ষমতায় আসলে চিরকালের জন্য এসে গেল -দলের এমন ধারণার কোনো স্থান নেই।’
‘বাাংলাদেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে নয়াগণতন্ত্রের জন্য বৌদ্ধিক জাগরণ সেই সঙ্গে গণজাগরণ-দুটোই অপরিহার্য। জাতির নবজন্মের কোনো বিকল্প নেই। জনগণ চাইলেই এবং চেষ্টা করলেই সম্ভব হবে নয়াগণতন্ত্র উদ্ভাবন ও প্রতিষ্ঠা, অন্যথায় হবে না। নয়াগণতন্ত্র হবে সমগ্র জনগণের ব্যাপার, কেবল মুৎসুদ্দি-ধণিক-বনিক-এনজিও-সিভিল সোসাইটির ব্যাপার নয়। নয়াগণতন্ত্রে সব রকম জুলুম-জবরদস্তি কঠোরভাবে দমন করা হবে।’
‘গণতান্ত্রিক গণরাষ্ট্রের জন্য জনচরিত্রকে উন্নত করতে হবে। জনচরিত্র নিকৃষ্ট থাকলে নেতাদের, দলের ও সরকারের চরিত্র উন্নত হতে পারে না। অপর দিক দিয়ে নেতাদের, দলের ও সরকারের চরিত্র নিকৃষ্ট থাকলে জনচরিত্র উন্নত হতে পারে না।..আর্থ সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে যাতে মানুষের অপরাধপ্রবণতা বা আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা একেবারে কমে যায়।’
নয়াগণতন্ত্রে নির্বাচন
নয়াগণতন্ত্রীরা নির্বাচনকে গ্রহণ করবে উদ্দেশ্য সাধনের অন্যতম উপায় রূপে, লক্ষ্য রূপে নয়। নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দল অবশ্যই পালন করবে জাতীয় ঐক্যের ও জনগণের উন্নতির দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প মেয়াদী কর্মসূচি। দলের ভেতরে থাকবে নয়াগণতান্ত্রিক আদর্শের অনুশীলন। কর্মসূচি নিয়ে কাজ করার ও আদর্শ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠবে দলের লক্ষ্য। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রীরা নির্বাচন করে, তবে প্রচারের বেলায় তারা মূল উদ্দেশ্য গোপন রেখে জনহিতকর অনেক কথাই বলে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রের নির্বাচন ও সরকার গঠনের বিভিন্ন রকম পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেসব দেশ থেকে অভিজ্ঞতা আহরণ করে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কাজে লাগানো যাবে।
‘ নয়াগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ হবে পাঁচ বছর মেয়াদী। নির্বাচন সম্পন্ন করবে সভাপতিসহ তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশনের সভাপতি ও সদস্যদের নিয়োগ দেবেন। প্রশাসন ব্যবস্থার সহায়তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন কাজ সম্পন্ন করবে। এর জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করা যাবে। হাইকোর্ট অনধিক তিন সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত মামলার রায় ঘোষণা করবে।’
‘প্রতিটি উপজেলা হবে জাতীয় সংসদের একেকটি নির্বাচন এলাকা। শহরগুলোতে যেখানে উপজেলা নেই সেখানে একটি কিংবা দুটি থানার এলাকা হবে একটি নির্বাচন এলাকা। নারী,পুরুষ, ধর্ম, গোত্র, নির্বিশেষে যে কেউ নির্বাচনবিধি অনুযায়ী জাতীয় সংসদের সদস্যপ্রার্থী হতে পারবে। নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও যাতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে তার জন্য বিশেষ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য অতিরিক্ত বিশটি সদস্যপদ সংরক্ষিত রাখা হবে। নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদে সদস্যদের ভোটে মহিলা সদস্যদের নির্বাচন সম্পন্ন করবে। তা ছাড়া মহিলা সদস্যদের সরাসরি গণভোটে নির্বাচিত হয়ে আসার পরিপূর্ণ সুযোগ রয়েছে। এজন্য বিশ বছর পার হলে সংরক্ষিত আসনের এই বিশেষ সুযোগ বিশ থেকে কমিয়ে আনা হবে, এবং আরো দশ বছর পরে অবশিষ্ট দশটি সংরক্ষিত আসনও বিলপ্ত করা হবে।’
‘প্রার্থীর নির্বাচনের খরচ প্রত্যেক প্রর্থীর জন্য সমভাবে সরকার বহন করবে। প্রচারকার্য, জনসভা ইত্যাদিও ব্যবস্থা সরকারি খরচে নির্বাচন কমিশন করবে।’
‘জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে দলভিত্তিক। তবে নির্দলীয় নাগরিকদেরও নির্বাচন প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকবে। নির্বাচিত নির্দলীয় প্রার্থীরা সংসদ-অধিবেশনে নির্দলীয় অবস্থানে থেকে মত প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ পাবেন। নির্দলীয় অবস্থানে থেকে মত প্রকাশের এবং যে কোন বিতর্কিত বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে মত প্রকাশের ও ভোট দেওয়ার সুযোগ তাঁর থাকবে।’
নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নবগঠিত জাতীয় সংসদের সদস্যেরা, নিজেদের মধ্যে থেকে একশো বিশজন সদস্য এবং নিজেদের ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জেলা পর্যায় পর্যন্ত নির্বাহী কমিটির সদস্যদের বাইরে থেকে আরো বিশজন বিশেষজ্ঞ সদস্য, নির্বাচন করে মোট একশ চল্লিশ সদস্যের ‘রাষ্ট্রসংসদ’ গঠন করবে। ‘রাষ্ট্রসংসদ’ গঠিত হলে রাষ্ট্রসংসদের সদস্যগণ জাতীয় সংসদে থাকবেন না। জাতীয় সংসদে অনুমদিত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রাষ্ট্রসংসদে উপস্থাপন করা হবে।..রাষ্ট্রসংসদের এবং জাতীয় সংসদের অনুমোদিত বিষয়গুলো রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করলে প্রশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়নে যাবে।’
‘মন্ত্রি পরিষদে অনধিক চল্লিশজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থাকবেন। তাঁরা একাধিক দল থেকে হবেন। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা হবেন সারা দেশে বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতে। সারা দেশে যেসব দল মোট প্রদত্ত ভোটের দশ শতাংশের কম ভোট পাবে, সে সব দল থেকে কোনো মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হবেন না। নির্বাচনে প্রার্থী-তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রত্যেক দল প্রার্থীদের অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা নির্বাচন কমিশনে জমা দেবেন। নির্বাচন সম্পন্ন হলে প্রত্যেক দলের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিক তালিকা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন মন্ত্রীদের নাম ঘোষণা করবে। কোনো মন্ত্রী -প্রতিমন্ত্রীর পদ খালি হলে আনুপাতিক হিসাব ও অগ্রাধিকার ভিত্তিক তালিকা অনুযায়ী নির্বাচিত সদস্যদের থেকে নির্বাচন কমিশন নতুন মন্ত্রীর নাম ঘোষণা করবে। প্রধানমন্ত্রী হবেন সর্বাধিক আসনপ্রাপ্ত দল থেকে, দলীয় অগ্রাধিকার ভিত্তিক তালিকা অনুযায়ী।
জাতীয় সংসদে এখনকার মতো কোনো বিরোধীদল, বিরোধীদলের নেতা ইত্যাধি থাকবে না। দলীয় পার্লামেন্টারি পার্টি থাকবে, প্রত্যেক পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা থাকবেন। মতামতের বেলায় প্রত্যেক দল স্বৈরতান্ত্রিক নীতির বদলে দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণের নীতি অবলম্বন করবে। নির্বাচন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।’
‘স্পিকার সর্বাধিক আসনপ্রাপ্ত দল থেকে হবেন। ডেপুটি স্পিকার হবেন আসন সংখ্যা বিচারে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল থেকে। রাষ্ট্রপতি হবেন জাতীয় সংসদের সদস্যদের থেকে সংসদে নির্বাচিত।’
‘নয়াগণতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও দেশব্যাপী শাখা কমিটি গঠনের নির্বাচন হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। দলের সংবিধানে নির্বাচন ও আনুষঙ্গিক সকল বিষয় স্বচ্ছরূপে বর্ণিত রাখা হবে।..দলের সংবিধান প্রণয়নের সময়ে লক্ষ রাখতে যাতে দলের নেতৃত্ব স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ না পায়। চার বছর পরপর নিয়মিত দলের কমিটিসমূহের নির্বাচন করতে হবে। দলীয় নির্বাচনেও গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোটররা ভোট দিবেন।’
‘দলের এবং দলের যে কোনো শাখায় সভাপতি পদে কোনো সদস্য সর্বাধিক বিশ বছর (একটানা বা বিরতিসহ) অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন, তার বেশি নয়। সাধারণ সম্পাদক পদেও নয়।’
নয়াগণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকার
‘জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রসংসদ আইন প্রণয়ন, আইন সংস্কার ও জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজ করবে। জাতীয় সংসদের জন্য বিভিন্ন মেয়াদের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বার্ষিক বাজেট সুপারিশ করার জন্য থাকবে পরিকল্পনা কমিশন ও মন্ত্রণালয়। জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রসংসদ আলোচনা-সমালোচনা ও পরিশোধনের মাধ্যমে সেগুলো চূড়ান্ত করবে, এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর সেগুলো স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের মাধ্যমে বাস্তবায়নে যাবে। জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রসংসদের সদস্যেরা কোনো নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবেন না। নির্বাহী দায়িত্ব পালন করবে স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন। স্থানীয় সরকারের উপর জাতীয় সংসদের ও রাষ্ট্র সংসদের সদস্যদের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না।’
‘স্থানীয় সরকার প্রশাসনের অধীনে থাকবে না। উপজেলা পরিষদে উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদাধিকার বলে সদস্য থাকবেন এবং দায়িত্ব পালন করবেন। জেলা পরিষদে ডেপুটি কমিশনার পদাধিকার-বলে সদস্যরূপে যুক্ত হবেন এবং দায়িত্ব পালন করবেন। স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত, তাদের কর্মপরিসর অনেক বিস্তৃত হবে।..স্থানীয় সরকারের পরিচালনায় গ্রামে ও শহরে সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সমবায় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।’
‘এক্সর্টানল রিসোর্সেস ডিভিশন ও এনজিও ব্যুরো কে পুনর্গঠিত, কার্যকর ও শক্তিশালী করা হবে। এনজিও ও সিভিল সোসাইটি সমূহের আর্থিক বিষয়গুলো উন্নয়ন পরিকল্পনার ও বার্ষিক বাজেটের অন্তর্ভক্ত করা হবে।’
‘পল্লী পঞ্চায়েত, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও সমবায় ব্যবস্থা নিয়ে হবে স্থানীয় সরকার। এজন্য থাকবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। চার বছর পরপর নির্বাচনের মাধ্যমে এগুলো গঠিত হবে।’
রেনেসাঁর পথ আমাদের পথ
এই চমৎকার শিরোনামটি আবুল কাসেম ফজলুল হক ব্যবহার করেছেন তাঁর একাধিক লেখায়। ‘অবক্ষয় ও উত্তরণ’ গ্রন্থে ‘রেনেসাঁর পথ আমাদের পথ’ ‘স্বাধীনতার পথ আমাদের পথ’ - এই দুটি হৃদয়গ্রাহী উপশিরোনাম দেখা যায়। ‘উনিশ শতকের মধ্যশ্রেণি ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে লেখক বাংলার রেনেসাঁ সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। ইউরোপ ও আমেরিকার বর্তমান যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিজয় তা অষ্টাদশ শতকের রেনেসাঁরই দান, রেনেসাঁ ও তৎপরবর্তীতে শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউরোপ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যায়; এর মধ্যদিয়ে তারা সামন্তিয় ভাবধারাকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে যুগের দাবিকে পূর্ণতা দিয়েছিল কিন্তু বিংশ শতকের প্রথমার্ধে একটি ও মধ্য পর্যায়ে আর একটি বিশ^যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের প্রগতিশীলতা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জোড়াতালি দেওয়ার কাজ চলতে থাকে। ক্ষয়ে যেতে থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, সংকট উত্তরণের জন্য বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে টিকিয়ে রেখে এর পরিধি বর্ধিতকরণের প্রক্রিয়া নিয়েছে সরকার।
জনগণকে তাঁদের নিজেদের সরকার গঠন করতে হবে, এর জন্য প্রয়োজন বৌদ্ধিক জাগরণ, চলতে হবে রেনেসাঁসের পথেই। এই রেনেসাঁ হবে নতুন সময় ও স্থান কালের প্রেক্ষিতে আধুনিক যুগের আধুনিক রেনেসাঁ, এটা স্পর্শ করবে সকল শ্রেণিকে, অতিক্রম করবে উনিশ শতকের রেনেসাঁর সীমাবদ্ধতাগুলোকে। লেখক বলেন, ‘ব্রিটিশ-শাসিত বাংলায় যে রেনেসাঁস দেখা দিয়েছিল, সূচনা-বিকাশ-পরিণতি অতিক্রম করে তা অবসিত হয়েছে, তার পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়। আজ দরকার নতুন কালের নতুন রেনেসাঁসের সূচনা। পুরাতন রেনেসাঁসের পুনরাবৃত্তি নয়, চাই নতুন কালের নতুন রেনেসাঁস।’ ৬৯ উনিশ শতকের রেনেসাঁ উচ্চবিত্তদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ‘বিত্তহীনের বিদ্যা নয়, বিত্তবানের বিদ্যাই –ঊনিশ বিশ শতককে নিয়ন্ত্রণ করেছে।’ বলেছেন বিনয় ঘোষ। ৭০ সেকালের আত্মীয় সভা, তত্ত্ববোধিনী সভা, বেথুন সোসাইটি, সুহৃদ সমিতি, সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা, সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা, বিদ্যোৎসাহিনী সভা, গুড উইল ফ্রেটানিটি, সঙ্গাত সভা প্রভৃত তৎকালীন প্রায় সব চিন্তার ক্ষেত্রগুলোকেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন বিত্তবান বিদ্বানেরা। মধ্যশ্রেণির যে অংশটি রেনেসাঁর নেতৃত্বের অংশ হতে পেরেছিল তাঁরাও মধ্যশ্রেণির সীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হননি। বিদ্যাসাগরের মত মনীষীও মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতার সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিয়ে জনশিক্ষা ও শ্রমিক শ্রেণির শিক্ষানীতির সমালোচনা করেন। ৭১ রামমোহন-দেবেন্দ্রনাথ-কেশবসেনের ভাবনাচিন্তা ও কর্মকা- আবর্তিত হয়েছে মধ্যশ্রেণিকে কেন্দ্র করে। ধর্মসভা ছিল উচ্চবণেরও হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান। বঙ্কিচন্দ্র কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও জমিদারতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অবসান কল্পে ও উন্নত সমাজব্যবস্থা গঠনে কোন ভাবনা করেননি। তিনি কৃষকদের মঙ্গল দেখেছেন জমিদারদের মহানুভবতার মধ্যে। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও উনিশ শতকের মনীষীরা নবযুগের আহ্বানকে অনুধাবন করেছিলেন। ব্রিটিশদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তৎকালীন বাংলার বিকাশমান মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি ইউরোপীয় দর্শন-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি, মনন মনীষা ও জীবন সাধনার রস আস্বাদনের সুযোগ পেয়েছিলেন। তারই ফলে বাঙালি-চিত্তের সঙ্গে পাশ্চাত্য-মনীষার এক প্রকার জৈব-রাসায়নিক সংযোগের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল নতুন মনীষার, আত্মপ্রকাশ করেছিলেন রামমোহন-অক্ষয়কুমার-বিদ্যাসাগর-মধুসূদন-বঙ্কিমচন্দ্র-প্রফুল্লচন্দ্র-জগদীশচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ। সন্দেহ নেই, ইংরেজদের প্রতি তাঁদের আকর্ষণ ছিল, ব্রিটিশ-শাসনের প্রতি তাঁদের স্বীকৃতি ও আনুগত্য ছিল, মধ্যবিত্তসুলভ অনেক সীমাবদ্ধতাও ছিল। তথাপি জীবনের প্রতি তাঁদের ভালবাসা ছিল, মানুষের অন্তহীন সম্ভাবনায় তাঁদের বিশ^াস ছিল। ব্রিটিশ শাসিত বাংলার বদ্ধ নিগড়ে তাঁদের বাস্তব ভূমিকা মধ্যশ্রেণিকেন্দ্রিক হলেও নিপীড়িত মানুষের প্রতি তাঁদের সহানুভূতি ছিল। এরই ফলে উনিশ শতকে সম্ভব হয়েছিল সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি।’ ৭২ ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনী সভার কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়ায় ধর্মসভা তৎপর ছিল, রক্ষণশীলেরাও তাঁদের ইতিবাচক চিন্তা দ্বারা সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ইয়ং বেঙ্গল তাঁদের অসহিষ্ণু ও উগ্রতার কারণে ক্ষয়িষ্ণ হয়ে যায়। চল্লিশ বছর ধরে হিন্দু কলেজ তাঁদের কর্মধারা চালিয়ে যায়। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পূর্বাপর বাংলার চেতনার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। মধ্যবিত্তসুলভ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই মহাবিদ্রোহের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চিন্তাধারা আশা-আকাক্সক্ষা উদ্দীপ্ত হয়েছিল ও কল্পনা মুক্তি পেয়েছিল। রামমোহন-অক্ষয়কুমার-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-গিরিশচন্দ্রঘোষ-রঙ্গলাল-হেমচন্দ্র-মধুসূদন-নবীনচন্দ্র-রামেন্দ্রসুন্দর-রবীন্দ্রনাথ-প্রমথ প্রমুখের মধ্য দিয়ে যে জাগরণের সূচনা হয় তার র্ভিত্তি মানবতাবাদ হলেও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-অরবিন্দ প্রমুখের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী চেতনাও জাগ্রত হয় এবং উনিশ শতকের জাগরণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের রূপ লাভ করে। এর সাথে সাথে মুসলমানেরা তাঁদের নিজস্ব ইতিহাস –ঐতিহ্য চেতনাকে সামনে রেখে প্যানইসলামি মতবাদ বিশ^ মুসলিম সংস্কৃতির বাণী প্রচার করলেও তাঁরা দৈশিক পরিচয়ও বিস্মৃত হয়নি।
রবীন্দ্র পরবর্তী ‘কল্লোল’ ‘কালিকলম’ ‘কবিতা’ প্রভৃতি সাহিত্য গোষ্ঠী নেতিবাচক চিন্তাচেতনাকে সম্মুখে রেখে সাহিত্য চর্চা আরম্ভ করলে রেনেসাঁর ধারাটি বিপথগামী হয়ে পড়ে। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব এবং ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে আশা জেগে ওঠে তাকে অপ্রধান করে আধুনিকতা না¤œী একটি হতাশাবাদী-শূন্যতাবাদী সাহিত্য ধারাকেই তারা মূলধারা করে তোলে। কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, অরবিন্দ পোদ্দার, বিনয় ঘোষ ও আরো অনেক কবি-সাহিত্যিকের মধ্য দিয়ে আর একটি দেশ-কাল সচেতন সাহিত্য ধারা গড়ে উঠছিল কিন্তু তার পরিপূরক কোন আন্দোলন বা সংগঠন দেখা না দেওয়ায় এই ধারা বিকাশ লাভ করতে পারেনি। ৭৩
‘১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিক থেকেই কলকাতার মার্কসবাদী কোন কোন চিন্তাবিদ রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখের চিন্তাধারাকে সামন্তবাদী বলে অভিহিত করে নাকচ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন।’ ৭৪ এই নেতিবাদী চিন্তার ধারা আরম্ভ হয়েছিল ’৩০ এর দশক থেকে তবে সে সময়ের সমালোচনা অনেকাংশে মার্জিত ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি, প্রগতি লেখক সঙ্ঘ, শিল্পী সঙ্ঘ, ভারতীয় গণনাট্য প্রভৃতি সংগঠন উনিশ তকের রেনেসাঁর বিরূপ সমালোচনায় তৎপর ছিল। নক্সালপন্থিরা উগ্র নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভেঙে ফেলেছিল রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মদুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, সুরেন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন প্রমুখের মূর্তি। ‘এরপূর্বে ১৯২০ –এর দশকে কল্লোল, কালি-কলম, কবিতা প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে পরিচালিত আধুনিকতাবাদী সাহিত্য আন্দোলনের সংগঠকেরাও উনিশ শতকী রেনেসাঁর বাঙালির বৌদ্ধিক জাগরণকে অবজ্ঞা ও ঔদাসিন্যের দৃষ্টিতে দেখেছিল। তাঁরা ইউরোপের রেনেসাঁর প্রতিও ছিল বিরূপ, জীবনকে তাঁরা কখনই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে পারেননি।’ ৭৫ কলকাতার এসব নেতিবাচক চিন্তাধারার প্রভাবে ঢাকাতে ১৯৬০-এর দশক থেকে উনিশ শতকের রেনেসাঁ বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়ে; আহমদ শরীফ, মোহাম্মদ মুর্তজা, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার প্রমুখের চিন্তায় এর প্রভাব দেখা যায়। অপর দিকে কলকাতার আধুনিকতাবাদীদের প্রভাবে পড়েন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ। স্যাড জেনারেশন, কণ্ঠস্বর গোষ্ঠী, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখের ওপর। ’৮০ দশকের বাংলাদেশের উত্তরাধুনিকেরাও রেনেসাঁর প্রতি কখনো কখনো উদাসীন, অনীহ-বিরূপ। ‘রেনেসাঁর স্পিরিট কমই খুঁজে পাওয়া যায় আজকের ঢাকার প্রবীণ ও তরুণ লেখকদের মধ্যে। এখন পাওয়া যায় আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, বিশ^ায়নবাদ, নি¤œবর্গ, মৌলবাদ বিরোধীতা আন্দোলন, উগ্র নারীবাদী আন্দোলন, মানবতাবাদী আন্দোলন, পরিবেশবাদী আন্দোলন, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলন, রাজনীতিকে বিদেশি দূতাবাসমুখী করে তোলার তৎপরতা, লোকসংস্কৃতি, নি¤œবর্গ ও আদিবাসী নিয়ে অতিউৎসাহ, জাতীয় সংস্কৃতির ধারণা বাদ দিয়ে সমন্বয়বিরোধী বহুত্ববাদী তৎপরতা, বাংলা ছেড়ে দ্রুত ইংরেজির দিকে যাত্রা, জাতীয় সংস্কৃতি ছেড়ে কথিত বিশ^ায়নের সংস্কৃতি তথা আকাশ সংস্কৃতির পেছনে ছোটা ইত্যাদি।’ ৭৬
উনিশ শতকের বাঙালি জাগরণের প্রতি সত্যেন সেন, নণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, আবদুল হালিম, সরদার ফজলুল করিম প্রমুখের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক ছিল। বাঙালি মুসলমানের মধ্যেও জাগরণ দেখা দিয়েছিল বিশ শতকের সূচনা থেকে। বেগম রোকেয়া, এস ওয়াজেদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, লুতফর রহমান, কাজী ইমদাদুল হক, আবুল হোসেন, শিখা গোষ্ঠী প্রমুখ লেখক ও সমাজ চিন্তকগণ রেনেসাঁর উত্তাপ অনুভব করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রেনেসাঁর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে আমাদের রেনেসাঁর পথকেই অনুসরণ করতে হবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সংগঠিত করতে হবে এই নবযুগের নব রেনেসাঁ। উনিশ শতকের রেনেসাঁর মতই এই রেনেসাঁ হবে মানবতাবাদী-সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী-রাজনীতি ঘনিষ্ট এবং জীবনবাদী। এই রেনেসাঁর আন্দোলন নঞর্থকতার বদলে সদর্থক জীবনদৃষ্টিকে সঙ্গী করে অগ্রসর হবে।
উপসংহার: বিশ^ ব্যাপী গণজীবনের ওপর নেমে আসছে দুর্যোগ, বিংশ শতকের বিপর্যয়ের পরে পুঁজিবাদী দেশগুলো ধনতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করবে আশা করা গিয়েছিল-ইউরোপ নিজ দেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার করলেও তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোতে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত থেকে গেছে, এসব দুর্বল দেশগুলোকে তাঁরা এখনো উপনিবেশ বলেই মনে করে। এসব দেশে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে কোন চিন্তা দাঁড়াতে পারছে না, জনচিন্তাকে ব্যাহত করতে এনজিও, সিভিল সোসাইটি, সরকারি ও বিদেশি বুদ্ধিজীবীরা তৎপর রয়েছেন; তাঁদের বিপরীতে প্রগতিশীল, শুভচিন্তক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নেই কোন ঐক্য এবং তাঁরা চিন্তার বিরোধ দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রস্তুতি ও যোগ্যতা অর্জন না করে কেবল আবেগ দিয়ে গণতন্ত্রের মত একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা দাঁড়াতে পরে না, এজন্য দরকার জনজীবনে বৌদ্ধিক জাগরণ, যে জাগরণ কেবল শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না সে জাগরণ হবে গ্রাম কেন্দ্রীক আর এই জাগরণের কেন্দ্রীয় চিন্তা হবে নয়াগণতন্ত্র। আশি বা নব্বই-এর দশকগুলোতে যে প্রকট দারিদ্র্য ছিল প্রযুক্তির কল্যাণে তা এখন দেখা যায় না কিন্তু দেশের নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পর্যায়ে বিক্ষুব্ধতা বৃদ্ধি পাচ্ছে; বাড়ছে রাজনৈতিক জটিলতা, পরবর্তী বছরগুলোতে জটিলতা বাড়বে বলেই সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ রয়েছে। ’৬৯ সালে জনআকাক্সক্ষাকে একটি নতুন উন্নত জীবনামুখে চালিত করা যেত কিন্তু সেই ব্যর্থতার দায় দেশকে আরো কিছুকাল বহন করতে হবে। আর সেই গণবিদ্রোহ শেষ বারের জন্যে ঘটে গিয়েছে সেটা ভাবার কোন কারণ নেই।
সামনের এই সংকটের কথা স্মরণে রেখে লেখক জাতিসঙ্ঘকে আন্তর্জাতিক ফেডারেল বিশ^-সরকারে রূপান্তরিত করা দরকার বলে মনে করেন, সেই সঙ্গে গণতন্ত্রে অবশ্যই সমাজতন্ত্রকে সংশ্লেষিত করে নিতে হবে। প্রতিটি রাষ্ট্র নিজ নিজ পরিবেশ –পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার গঠন করবে, এতে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই পথ অত্যন্ত জটিল ও নানা প্রতিবন্ধকতায় পূর্ণ। এর জন্যে দরকার গণজাগরণ, দরকার রেনেসাঁস; নতুন যুগের নতুন রেনেসাঁস। বৌদ্ধিক আন্দোলন ব্যতীত কোন ব্যবস্থাই স্থায়ী হবে না তাই প্রগতিশীল শক্তিসমূহকে জনগণের চিন্তাগত মান উন্নয়নে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। পৃথিবীর দেশে দেশে জাগরণ দেখা যাচ্ছে তবে সেটা ধর্মের পুনঃপ্রত্যাবর্তন বলেই মনে হচ্ছে, মধ্যযুগীয় সংঘাত পুনরায় শুরু হতে যাচ্ছে পৃথিবীতে, বর্তমানে ধর্মের সংগে যুক্ত হয়েছে সা¤্রাজ্যবাদীদের নানামুখি অপতৎপরতা। ‘পৃথিবীর সর্বত্র সব দেশেই সর্বজনীন গণতন্ত্র বা নয়াগণতন্ত্র অবলম্বন করে গড়ে তুলতে হবে নতুন জাতিরাষ্ট্র-নয়াগণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র। আর আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক ও বিশ^ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গড়ে তুলতে হবে আন্তর্জাতিক ফেডারেল বিশ^ সরকার। বিশ^ সরকার হবে সব জাতিরাষ্ট্রের সরকারসমূহের উর্ধ্বতন এক সরকার।’ ৭৬ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর মানুষেরা পরস্পরের নিকটবর্তী হয়েছে, বর্তমান সময়ের যে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা তা অনেকাংশে কৃত্রিম, এই প্রতিকূলতাকে জয় করে মানুষ সম্মুখে অগ্রসর হবে অথবা যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে এর বিকল্প নেই।
তথ্যসূত্র:
১ বাংলা একাডেমি লেখক অভিধান, ২০০৮, পৃ.৪৮
এসো বিদ্রোহ করি, হাসান ফকরী; ফেব্রুয়রি-২০০৮
লোকায়ত; বর্ষ-২৭, সংখ্যা-২, আগস্ট-২০১০, পৃ. ৬৪-৬৮
দীপন হত্যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক: আবুল কাশেম ফজলুল হক, দৈনিক ইত্তেফাক, অক্টোবর-২০১৫
২ বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য, আবুল কাশেম ফজলুল হক প.-৪৯
৩ আবুল কাশেম ফজলুল হক, বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য, কথা প্রকাশ, আগস্ট-২০১৫, পৃ.-৪৯
৪ সাক্ষাতকার-শরিফুজ্জামান, প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, ২/১১/১৫
৫ দ্য আলকেমিস্ট, ঐশী পাবলিকেশন্স, ডিসেম্বও -২০১৪, পৃ. ২০ ও ৪৮
৬ বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, বিনয় ঘোষ, পৃ. ৯, বুক ক্লাব, বাংলা বাজার।
৭ ভারতীয় ইতিহাসের কাল পঞ্জি, মার্কস, পৃ.৯
৮ বাঙালির লৌকিক ঐতিহ্যে সমাজতান্ত্রিক উপাদন, পৃ. ২৯, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, যতীন সরকার
৯ আবুল কাশেম ফজলুল হক, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, পৃ. ২৩৯
১০ দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা,যতীন সরকার, পৃ.১৯
১১ আবুল কাসেম ফজলুল হক, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, পৃ. ২৪৪
১২ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, আবুল কাশেম ফজলুল হক পৃ. ২৪৬
১৩ বাংলাদেশের প্রবন্ধ্র সাহিত্য, আবুল কাশেম ফজলুল হক ,পৃ. ১১৫
১৪ প্রাগুক্ত, ২৭
১৫ প্রাগুক্ত ৩৩
১৬ প্রাগুক্ত ৩৬-৩৭
১৭ বাংলার বিদ্বৎ সমাজ, পৃ. ১৫২, তাপসী প্রিণ্টার্স, মার্চ, ১৯৭৮।
১৮ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, হাসান আজিজুল হক, কথা প্রকাশ, পৃ.১৩
১৯ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, আবুল কাশেম ফজলুল হক ্র-২৫৭
২০ প্রবন্ধ সমগ্র -৩, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, পৃ. ৪২৩
২১ উত্তর-আধুনিকতা একবিংশ শতাব্দীর ভাববাদ, মানব মুখার্জী, উত্তরাধিকার, ৬২ তম সংখ্যা, পৃ. ৬২
২২ শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ, হুমায়ুন আজাদ
২৩ আধুনিকতাবাদ ও জীবনানন্দেও জীবনোৎকণ্ঠা, আবুল কাসেম ফজলুল হক, পৃ. ১২
২৪ গণতন্ত্র ও নয়াগণতন্ত্র, আবুল কাসেম ফজলুল হক, পৃ. ৭৪
২৫ প্রাগুক্ত পৃ. ৯৪
২৬ বুদ্ধিও মুক্তি আন্দোলন ও উত্তরকাল, আবুল কাসেম ফজলুল হক, পৃ. ৫৪ ও ৫৯
২৭ প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫
২৮ প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৬
২৯ প্রবন্ধ সমগ্র, আহমদ ছফা, পৃ. ২৩১
৩০ অবক্ষয় ও উত্তোরণ, আবুল কাসেম ফজলুল হক পৃ.১৪
৩১ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, যতীন সরকার, কথা প্রকাশ, পৃ. ১৮৬
৩২ বুদ্ধিজীবীর নোট বই, পৃ. ৩২৯
৩৩ প্রবন্ধ সমগ্র, আহমদ ছফা, হাওলাদার প্রকাশনী, পৃ-
৩৪ প্রথম আলো মার্চ/২০১৭
৩৫ লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব, পৃ.১৭
৩৬ দ্বিজাতি তত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান-চেতনা, যতীন সরকার, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, পৃ. ১১৮
৩৭ গণতন্ত্র নয়াগণতন্ত্র, আবুল কাসেম ফজলুল হক পৃ. ৮৯
৩৮ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, আবুল কাশেম ফজলুল হক,পৃ. ২৬৩
৩৯ উত্তর আধুনিকতা, এজাজ ইউসুফী, পৃ. ২৩৪
৪০ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, আবুল কাসেশ ফজলুল হক, কথা প্রকাশ, পৃ. ৫৬
৪১ রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি’, আবুল কাসেম ফজলুল হক পৃ. ২৮
৪২ প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১
৪৩ প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮
৪৪ বুদ্ধিও মুক্তি আন্দোলন ও উত্তরকাল, আবুল কাশেম ফজলুল হক পৃ. ৫৮
৪৫ তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রথম বাংলাদেশ সরকার, আবুল কাসেম ফজলুল হক পৃ. ৪৬
৪৬ প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২
৪৭ নির্বাচিত রচনা: কাজী নূর-উজ্জামান, পৃ. ২৭৬
৪৮ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, আবুল কাশেম ফজলুল হক, পৃ. ১৪৬
৪৯ ‘রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি’, আবুল কাসেম ফজলুল হক, পৃ. ৬২
৫০ তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রথম বাংলাদেশ সরকার, আবুল কাসেম ফজলুল হক, পৃ. ৩১
৫১ রাজনীতিবিদগণ, হুমায়ুর আজাদ
৫২ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, আবুল কাশেম ফজলুল হক পৃ. ১৩৭
৫৩ নেতৃত্ব সংকট, নির্বাচিত প্রবন্ধ, আহমদ শরীফ, পৃ. ২১৮
৫৪ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, আবুল কাশেম ফজলুল হক পৃ. ১৪৫
৫৫ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, প্রাগুক্ত পৃ. ১৪০
৫৬ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, প্রাগুক্ত পৃ. ১৪১
৫৭ বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও সমাজ, অনুপম সেন, পৃ ৪১
৫৮ প্রাচুর্যে রিক্ততা, আবুল কাসেম ফজলুল হক, কথা প্রকাশ, পৃ. ৩৩
৫৯ প্রাচুর্যে রিক্ততা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩
৬০ বাংলাদেশ কোন পথে, আবুল কাসেম ফজলুল হক, ৪৮, ৫৪, ৫৭
৬১ প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদেও বেতার ভাষণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: তৃতীয় খ-, পৃ. ৭
৬২ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে, বদরুদ্দীন উমর, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশ, পৃ. ১৪
৬৩ প্রাচুর্যে রিক্ততা, পৃ. ৯৩
৬৪ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে, বদরুদ্দীন উমর, পৃ. ৩৫
৬৫ প্রাচুর্যে রিক্ততা, আবুল কাসেম ফজলুল হক, পৃ. ৯৩
৬৬ অভিজ্ঞতাবাদ (রাজনীতির অভিধান, সৌরেন্দ্র মোহন গঙ্গোপাধ্যায়, পৃ. ২০)
৬৭ সমাজতন্ত্র, অনুপ সাদি, কথা প্রকাশ, পৃ. ২১-২৮
৬৮ বুদ্ধিজীরীর নোট বই, পৃ. ৩২৮
৬৯ উনিশ শতকের মধ্যশ্রেণি ও বাংলা সাহিত্য, আ.কা.ফ.হ, পৃ. ৯৪
৭০ বাংলার বিদ্বৎ সমাজ, পৃ. ১৫২, তাপসী প্রিণ্টার্স, মার্চ, ১৯৭৮
৭১ উনিশ শতকের মধ্যশ্রেণি ও বাংলা সাহিত্য, আবুল কাসেম ফজলুল হক,, পৃ. ৬৫
৭২ প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৪
৭৩ প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬
৭৪ অবক্ষয় ও উত্তরণ, আবুল কাসেম ফজলুল হক,, পৃ. ১৭৩
৭৫ প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৩
৭৬ প্রাগুক্ত পৃ. ১৭৫