শনিবার, ৩ মে, ২০১৪

পাটগ্রামের বুড়ো

                                                       
                                                            চার্বাক সুমন
আমরা যখন পাট-গ্রামে পৌঁছলাম তখন গাছেরা পাতা ঝড়িয়ে ফেলছে।চলছি আমরা জুবুথুবু হয়ে, গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে উত্তরে হাওয়া আর তার সাথে উড়ে আসা ঝরা পাতা। শিমুল গাছ গুলো হয়ে উঠেছে দেখার মত; গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে পথের দু পাশ জুড়ে-তাদের মাথাগুলো উঠে গেছে অনেক উঁচু অব্দি। পাখিরা মধু  নিয়ে ঝগড়া করছে মগ ডালগুলোতে।
কলসী মুখে এসে পৌঁছলাম সন্ধ্যা নামার খানিক লালেচ সূর্যটা একটু পরেই ঢলে পড়বে-নদী, ধান ক্ষেত, তারপর ভারতের চা বাগানগুলোর ওপাড়ে। রাস্তাটা এখানে কলসীর গলার মতই সরু, উত্তরে পাটগ্রাম শহর, তারপর ছিটমহলের ওপাশে ভারত। পেছনে পড়ে রইল বাংলাদেশ।

শহরে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। শীতে তখন সকলে কাঁপছি-একটা আস্তানা চাই , যত দ্রুত সম্ভব। আমাদের ইনেত এলো এক বুড়ে। বুড়োকে দেখে বিরক্তি এলো, আবার মায়াও হল বুড়োর জন্য। কনকনে শীত তার সঙ্গে জুড়েছে শৈত্য প্রবাহ। অথচ বুড়োর পায়ে সাধারণ চটি, পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি, এসবের উপরে চাদর মত কী একটা জড়ানো।
--আপনারাই এসেছেন বুঝি? বললেন বুড়ো।
--তা এসেছি। আপনাকে পাইঠয়েছে বুঝি?
--আমাকেই পাঠিয়েছে। বুড়ো বললেন শীতে কাঁপতে কাঁপতে
ভেবেছিলাম শহরের নিকটেই কোথাও বিছানা পাতা রয়েছে, গিয়ে কেবল শুয়ে পড়লেই হবে ইকন্তু বুড়ো বললেন, যেতে হবে আরও মাইল পনের। বুড়ো আরও বললেন, ভয় পাবেন না, যাব আমরা পাগলু গাড়িতে, পদরা গুলো নামিয়ে দিলে গায়ে বাতাস লাগবে না। তার পূবের আসন সকলে মিলে চা খাওয়া যাক।
চা খেলাম খুব আরাম করে, রাস্তার পাশে চায়ের দোকান-বাচ্চা-বুড়ো সকলে চা, পিঠার স্বাদ নিচ্ছে। আবাক লাগছে ওদের দেখে, এদের আগে কখনও দেখিনি। ট্রেন স্টেশনটা নিকটেই, সেখানেও অনেক মানুষের ভিড়। ট্রেন একটা এলো বুড়িমারি থেকে আরপর প্রস্থান করল খুব ধীরে ধীরে।
--ওটা বুড়িমারি এক্সপ্রেস ,এসেছে বুড়িমারি থেকে, সেখান থেকে মাল আর যাত্রী নিয়ে এসেছে যাবে ঢাকা। বুড়ো বললেন কাউএক লক্ষ্য না করেই।
ভ্যান একটা ক্যাচ ক্যাচ করতে করতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তিনজন যাত্রী নিয়ে। মনে জাগে কত দাশরিনকতা ভাবলাম, যে ভ্যানটি এখানে চলছে-ওরকম আরও কত ভ্যান চলছে সাতক্ষীরা বা বরিশালে। কতই না ক্ষুদ্র আমরা পৃথিবীর কতটুকুই বা দেখতে পাই।
আবাসে পৌঁছেই বিছানা নিলাম সদলবলে, পরের দিন বিছানা ছাড়লাম বেলা করে বলাই বাহুল্য। তখনও কেউ ওঠেনি, ওদের কেউ কেউ তাস খেলেছে, কেউবা গল্প করেছে রাত জেগে নতুন স্থানে আসার আনন্দ নিয়ে।
দু তিনটি ঘুঘু ডাকছে অবিরাম
--পাটগ্রামে ঘুঘু বেশি। একসময় শিকারীরা ঘুঘু মেরে কমিয়ে দিয়েছিল, এখন আবার বাড়ছে। বুড়ো বললেন আমাকে লক্ষ্য করে।
--অনেক দিন ঘুঘুর ডাক শুনিনি। গ্রামে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে এরূপ ঘুঘুর ডাক শুনেছি।
--এখানে আরও এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে আরও বেশি পাখি দেখা যায়। আপনি চাইলে নিয়ে যেতে পারি। বুড়োর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম, বনে বাদারে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম গ্রামীণ প্রকৃতির রূপ। এর পর থেকে বুড়োর সঙ্গে আলাদা একটা ভাব জমে গেল আমার। তার সঙ্গে প্রায়ই ঘুরতে যেতাম সীমান্তবর্তী গ্রাম কালির হাটে অথবা ভারতীয় সীমান্তে যেখানে বিএসএফরা টাওয়ারের উপরে বসে পাহাড়া দিচ্ছে। বুড়ো আরও আমাকে দেখাতেন মরে যাওয়া নদী, পুরণো গাছ, পাখিদের আস্তানা, পুরণো থান। শেখাতেন মাছ শিকারের নতুন নতুন পদ্ধতি। সুযোগ পেলেই বুড়োর কাছ থেকে শুনে নিতাম তার অতীত জীবনের কাহিনী-তার চাওয়া পাওয়া আর দুখ-সুখের নানা স্মৃতি।বুড়ো সেসব বলতে চাইতেন না, আবার কোন কোন সময় নিজ থেকেই বলতে থাকতেন আপন মনে। তাকে বাঁধা দেইনি কোন দিন, তার জীবনের কথা শুনতে ভালই লাগত, ভাল লাগত বিভিন্ন বিষয়ে তার ব্যাখ্যা শুনতে।

একদিন একটা নালা দেখিয়ে বললেন, অনেক বড় নদী ছিল এটা। স্রোত ছিল ধরলার চেয়ে বেশি। কিন্তু দেখ এখন, কে বলবে এককালে এটা নদী ছিল।
--এর সঙ্গে নিশ্চয় অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে আপনার?
--তা আছে। সবটা পরিষ্কার করে স্মরণ করতে পারি না।
--কী নাম ছিল নদীটার?
--মরে যে গেছে কী এসে যায় তার নামে। বুড়ো বললেন দীঘর শ্বাস ফেলে।
--আর তিনি কোথায় আছেন এখন?
--কার কথা বলছ? বুড়ো অবাক হয়ে বললেন।
--নিশ্চয়ই কারো না কারো স্মৃতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। বললাম আমি।
--ছিল কেউ একজন। বিয়ে করেতে পারিনি ওকে, দরিদ্র ছিলাম কিনা। সে ছিল ভদ্র ঘরের মেয়ে-পরিষ্কার জামা পড়ত, ফিটফাট থাকত। প্রায়ই সে নদীটা দেখতে আসত আর আমি দেখতে আসতাম ওকে।
--কথা হয়নি কখনও?
--হয়েছিল, নদীর পাড়ে বসতাম একসাথে, কাশ ফুল ছিঁড়ে দিতাম ওর হাতে। দেবার মত আর কিইবা ছিল বল?
--এখন কোথায় তিনি?
--বছর খানেক হল মারা গেছে। বুড়ো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
নদীর পাড় ধরে হাটতে হাটতে গেলাম অনেক দূর অবধি, পরপর দুটি ট্রেন আমাদের অতিক্রম করে গেল। সূর্যটা ডুবে গেল ধানের ক্ষেতের ওপাড়ে-গাছের সারির আড়ালে। সন্ধ্যা নামলে আমরাও নীড় প্রত্যাশী পাখির মত ফিরতি পথ ধরলাম।
 
একদিন বুড়ো আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বুড়োর বাড়ি একটু ভিন্ন ধরণের, খাস জমিতে চারটি মাত্র খুঁটি গেড়ে তৈরি করেছেন চালা-সেটাই তার আবাস-স্থল। উঠোনে ছড়ানো রয়েছে কিছু মাটির আর প্লাস্টিকের থালা বাসন।
--এই হল আমার বাড়ি। বললেন বুড়ো, এটা ঠিক তোমার বাড়ির মত নয় নিশ্চয়?
--আমাদের নিজেদেরই রান্না করতে হবে। বুড়ো বললেন আবার, কেউ তো নেই যে রান্না করে দেবে।
--বিয়ে করেন নি কেন?
--সেটা জানবে‌‌‍‍‌’খন। আগে রান্নাটা চড়িয়ে দেই। বনভোজন হয়ে যাবে একটা কি বল?
বন থেকে কুড়িয়ে আনা খড়ি আর খড় দিয়ে রান্না চড়ালেন বুড়ো। বললেন, এটা হল সবজি খিচুড়ি। আমার খুব পছন্দের বস্তু।
--আমারও তাই, বললাম আমি তাকে উৎসাহ দেবার জন্য। কিন্তু তার রান্নার পদ্ধতি দেখে হতাশ হয়ে পড়লাম, শেষ পর্যন্ত ক্ষুধা নিবৃত্তি হবে-সে বিষয়ে শংশয়মুক্ত হতে পারলম না।
--রান্না এখুনি হয়ে যাবে তুমি ততক্ষণে ভেতরে গিয়ে বই পড়গে।
ভেতরে কিছু ধূলি মলিন বই পেলাম, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে দরশন ,রাজনীতি, বিজ্ঞানের বই। বুড়ো যে একজন উঁচু মানের পাঠক সে বিষয়ে সন্দেহ রইল না।
--বইগুলো কি আপনার? বললাম তাকে।
--কে আর দিবে বল, নিজেকেই সংগ্রহ করতে হয়েছে।
--এটা তো মনে হচ্ছে--
--মাকৃসীয় দর্শনের বই। বুড়ো বললেন দ্রুত, এসব বই পড়েছি অনেক আবেগ নিয়ে-মাঠে কাজ করেছি ত্রিশ বছর-আর তার ফল দেখ-
--কোন দলের সাথে ছিলেন?
--জাসদ,বাসদ,কমিউনিস্ট-পাটি বাদ যায়নি কোনটাই।
--এই পরিণতি কি করে হল আপনার?
--অসুস্থ হয়ে পড়েছি কাজ করতে পারিনা।সরকারি জমিতে থাকার জমিটুকু পেয়েছি এই তো অনেক। এনজিওদের ফাই ফরমাস খেটে দেই-এই যেমন তোমাদের খাটছি। এভাবেই জীবনের যতটা সময় বাড়িয়ে নিতে পারি ।
--দলের কমরেডরা খোঁজ নেয় না?
--সেই পাটি আর তৈরি করতে পারলাম কোই বল। সবটার মধ্যে ছিল ফাঁকি। ভাব একবার, উন্নয়নের কাজ এনজিওদের দিয়ে করাচ্ছে সরকার, আর আমি খেদমত করছি ওদের-। এই হল ব্যাপার।
--যুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন?
--৫ নং সেক্টরে কাজ করেছি। কত খেল যে দেখলাম রে বাবা, ভারতীয় কমাণ্ডার এক মুক্তিযোদ্ধাকে পিটিয়ে মেরে ফেললে এচোখের সামনে-শুধু আদেশ মানেনি, এই ছিল তার দোষ।দেশ স্বাধীন করলাম,তারপর ভাবলাম দেশটা গড়ে দিয়ে যাই। চেয়ে দেখ একবার কী দেশ আর কী তার মানুষ! আর দেখ নষ্ট দলগুলোর দিকে, বিশ্বাসঘাতক সব-খতম করে দেওয়া দরকার।
এরপর থেকে বুড়োর সঙ্গে দেশ , রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। সব বিষয়েই বুড়োর থাকত নিজস্ব কোন না কোন দৃষ্টিভঙ্গি। আর সব সময় যেটা হত বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি হাল ছেড়ে দিতেন, হতাশ হয়ে গুম হয়ে বসে থাকতেন। বলতেন, এসবে এখন কী এসে যায়? মানে হয় না এসব ছেলে খেলার। এর চেয়ে ভাল ছিল সংসার করে ছেলে পেলে মানুষ করা। হতচ্ছাড়া কারবার যত।
এই অবস্থা থেকে বুড়োকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হত, মাথাটা তার ঝুলে থাকত নিচের দিকে; চোখ হয়ে উঠত ছলছলে।
--আপনার দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন । সব কিছুর বোঝা আপনি নিতে পারেন না।
--তা হতে পারে । আমার জীবনটার দিকেই একবার চাও, এই কী জীবন? কী এসবের মানে? একটা সময় ছিল গর্ব করে বলতাম, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় লেখক হব। -ওসব ভাবলেই মাথাটা হেঁট হয়ে যায়। লজ্জায় কাদার ভেতর সেঁধিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। মেয়েটাকেও কিছু দিয়ে যেতে পারলাম না, ভাব একবার দায়বদ্ধ থেকে গেলাম সবার কাছে।
--মেয়ে আছে আপনার ? জানা ছিল না। কোথায় থাকে সে?
--আছে একটা হতভাগা মেয়ে। পনের ষোল বছর হবে । একদূর সম্পকেরর আত্মীয়ের বাড়িতে থাকে,দাসীগিরি করে ওখানে।
--তবে আপনি পুরোপুরি একা নন।
--নই, তবে এটা অন্য ধরণের একাকীত্ব। কে আছে কে নেই তা দ্বারা এটা নির্ধারণ করা যায় না। এই অবস্থাটা হল মরা নদীটার মত- কেউ বলে আছে, কেউ বলে নেই।
--আমি অবশ্য এটাকে ভিন্নভাবে যাচাই করতে চাই। বুড়োকে বললাম সান্ত্বনা দেবার জন্য, প্রকৃতি সবার কাছে সমান কাজ আশা করে না। যার যতটা ক্ষমতা তার কাছে ততটাই নেয়। কতটা করতে পারলাম সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমি চেষ্টা করেছি এই হল কথা।
বৃদ্ধ হঠা‌ৎ আবেগ তাড়িত হয়ে আমার হাত দুটি ধরে ফেললেন। বললেন, অনেক সান্ত্বনা দিলে বাবা!অনেক বড় সান্ত্বনা পেলাম!ব্যথার একটা জীবন-অনেক আরাম লাগছে এখন।
বুড়োর মেয়েকে দেখতে গেলাম একদিন। বাংলাদেশ ভারতের মধ্যবর্তী একটা গ্রাম তারই শেষ বাড়িটায় গেলাম আমরা; বুড়োর মেয়েকে দেখে হতাশ হয়ে গেলাম। মলিন মুখ, ছিন্ন বস্ত্র, লালচে চুল, চোখে বেদনা আর অভিমানের ছলছলে জল। ধূলি মলিন একটা ফুলের মতই সে ম্রিয়মাণ।
বুড়ো বললেন, দেখ তো তোমার মত একটা ছেলে ওর জন্য জোটে কিনা। বুড়োর সাথে এক মুহুতর দৃষ্টি বিনিময় হল। উভয়ই চোখ ফিরিয়ে নিলাম পর মুহূতর। সে দিন আর বেশি ঘোরাঘুরি হল না; বাসায ফিরে ভাবতে থাকলাম বুড়োর মেয়ের কথা। ওর বেদনাদীণর চোখ ভুলতে পারি নি অনেক দিন। তার চোখ দুটি যেন বলছিল, আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও-পৃথিবীর সব থেকে নিখুঁত ভালবাসা তোমাকে দিব।
কিন্তু জীবনের হিসেব সকল ক্ষেত্রে মেলে না। চাকরির প্রয়োজনে ঢাকা ফিরতে হল। ফিরেই বুড়োর চিঠি পেলাম, বুড়ো আর একবার সেখানে যেতে বলেছেন। দুটি বই এর কথাও লিখে পাঠিয়েছেন। দ্রুত সেগুলো কিনে পাঠিয়ে দিলাম।
আবার ফিরলাম ছয় মাস পর। স্থান নিলাম সেই পোড়ো বাড়িটাতেই। এবার এসেছি একা তাই বুড়োর সঙ্গে আরও ভালভাবে সময় দিতে পারলাম। পাটগ্রামের প্রতিটি হাট, সীমান্তবর্তীর গ্রাম, নদী, পুকুর, বন তিনি ঘুরে ঘুরে দেখালেন। খনি থেকে পাথর তোলা হচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে বললেন, কী আশ্চর্য দেখ-খনিতেও পাথর হয়। ভারত থেকে আসছে দুধ সাদা পাথর দেখলেই কামড় বসাতে মন চায়। কত বড় দুনিয়া-কীই বা এর দেখলাম বল।
রাতের গ্রাম বুড়ো খুব পছন্দ করতেন-অনেক রাত তার সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাটিয়েছি; কাটিয়েছি নদীর পাড়ে, বনে, ধান ক্ষেতে, মুক্ত মাঠে, পথের ধারে। প্রতিটি বস্তুর পেছনেই তিনি কোন না কোন দর্শন দাঁড় করাতেন। হয়তো জোনাকিদের দেখে বললেন, জোনাকিরা আলোকিত কিন্তু তাদের পৃথিবীটা অন্ধকার। তারাদের দিকে তাকিয়ে বলতেন,আমরাও ওই তারাদের মতই নি:সঙ্গ। ওরা চিরজীবী আর আমরা মৃতজীবী এই পার্থক্য। নদীর দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, জলের তলে থাকে বালি-বালির তলে কত প্রাণী মাথাগুঁজে জীবন অতিবাহিত করছে। আমাদের অনেকের জীবন তাদের অনেকের অধম।
বুড়ো কাছে তার মেয়ের প্রসঙ্গ তুলতে পারছিলাম না; বুড়ো নিজেই বললেন তার মেয়ে সম্পর্কে, আমাকে তার মেয়ের বাড়ি যেতে বললেন। সেটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। কি করে চাইব ওর চোখের দিকে? আলোচনার বিষয়ই বা কী হবে?
একদিন বুড়ো একটা স্ট্যাম্প নিয়ে এলেন । জেদ ধরলেন, একটা উইল লিখে দিতে হবে।
--কিসের উইল? সম্পত্তির উইল লিখতে হলে উকিলের কাছে যেতে হবে।
--এতদিনে কি বুঝলে না যে আমার কোন সম্পত্তি নেই। বললেন বুড়ো
--তবে ?
--জীবনের উইল করব।
তার জীবনের উইল করলাম দুজনে মিলে, উইলের প্রধান বিষয়গুলো হল-দুরারোগ্য কোন ব্যাধি হলে যেন চিকি‌ৎসা করা না হয়, লাইফ সাপোটর দেওয়া থাকলে সেটা যেন খুলে নেওয়া হয়, মৃতদেহ পাবে মেডিকেল কলেজ। বুড়োর উইল লিখে বাড়ি ফিরলাম অনেক রাত করে। মাথায় ঘুরতে লাগল নানা বিষয়।
এরমধ্যে অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটল। বাড়ি থেকে শ্মশান দেখা যায় তা পূবেরই বলেছি, সে দিন রাতে শ্মশানের দিকের জানালাটি খুললাম, কবরের উপরে হেলে পড়া গাছটা দেখা যাচ্ছিল জানালা দিয়ে। আলো ফেলতেই কী একটা যেন দ্রুত সরে গেল। ভাবতে লাগলাম কী হতে পারে ওটা?
পরদিন বুড়ো বললেন, অত রাত পর্যন্ত জাগ কেন?
--তবে ওটা আপনিই ছিলেন? কী করছিলেন ওখানে?
--মৃতদের সামিল হলে কেমন লাগবে তাই দেখছিলাম।
--কী উপলব্ধি হল?
--উপলব্ধি হল জীবিত আর মৃতরা সম্পূর্ণ আলাদা। মৃতরা জানেনা যে তারা মৃত , আর জীবনের সে কী জানে যে এখনও জন্মায়নি? -এই হল ব্যাপার।
আবার ফিরতে হল ব্যস্ত জীবনে। কখনও কখনও বুড়োর চিঠি পেলে যত্ন করে উত্তর দিতাম। এক সময় চিঠির পরিমাণ কমে এলো। বছর দুয়েক পর আবার যখন সীমান্তবর্তী গ্রামটিতে যাবার প্রয়োজন হল তখন বুড়োর কথা মনে পড়ল। বুড়ো মারা গেছে অন্তত ছয় মাস পূবরে। তার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, এই হল জীবন। বুড়ো মৃত্যুকে জানতে চেয়েছিলেন-এখন তার হাতে অনেকটা সময়। বুড়োর মেয়ের কথা মনে পড়ল। তার ছেলে হয়েছে। ইচ্ছে হল দেখা করে আসি, কিন্তু সাহস হল না-এতদিন পরে কী প্রয়োজন?
এই হল জীবন- যার সব হিসেব নিজের মত করে মেলানো যায় না।বুড়ো এটা বলতেন প্রায়ই।       


 

1 টি মন্তব্য:

  1. গল্পটা পড়লাম। বুড়ো বা গল্পের কথক কেউই বিকশিত হয়নি, সেই কারণে গল্পের গতিটা খুব শ্লথ ছিল। এমন বুড়ো মারা গেলে বা বেঁচে থাকলে কি ক্ষতি বা লাভ, তা পাঠকের কাছে স্পষ্ট হবার কোনো কারণও গিবর্ণিত হয়নি। পাঠক বুড়োকে মূলত জেনেছে চিত্রে বা অবস্থায় নয়, বরং কথকের বর্ণনায়, সেই কারণে পাঠকের কাছে এই বুড়ো সম্পর্কে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে ধরা পড়বার ও তার আবেগের সাথে মিশবার কোনো কারণ কারণ সৃষ্টি হয়নি।

    যেভাবে গল্পটি শুরু হয়েছিল, সেভাবে এগিয়ে শেষ হলে উপরের ত্রুটিগুলো থেকে এটি মুক্ত হতে পারতো, চার্বাক..

    উত্তরমুছুন