রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৩

বেলাভূমি


প্রকৃতি তার হৃদয়ে অগণিত রহস্য আর বিস্ময় সঞ্চয় করে রেখেছে আমাদের জন্য। আমরা মানুষেরা কখনই প্রকৃতির সব নিয়ম জানতে পারব না, কারণ প্রকৃতি তা জানতে দিতে চায় না কেননা এতে সৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে । কিন্তু মানুষ অনুসন্ধান করে চলেছে, প্রকৃতির হৃদয়ের কথাটি উন্মোচন না করে সে যেন ক্ষান্ত হবে না।

এজন্যে মানুষকে প্রথমে অসীম দূরত্বকে জয় করতে হবে, জানতে হবে সময়ের রহস্য এবং স্থানের ডাইমেনশনের বিস্ময়। ড.নির্ঝর দীর্ঘদিন ধরে স্থানের ডাইমেন নিয়ে কাজ করছেন, মানুষ যে দিন ডাইমেনশনের রহস্য উৎঘাটন করতে পারবে সেদিন সে সময়ের বুকে নির্মাণ করবে এক সুপ্রশস্ত মহাসড়ক যেটা ধরে সে চলে যাবে মহাশুণ্যের যে কোন স্থানে। ড. নির্ঝর বিশ বছর ডাইমেনশনের রহস্য উৎঘাটনের প্রচেষ্টায় রত রয়েছেন, তিনি এমন একটি মহাযন্ত্র নির্মাণের  প্রচেষ্টায় নিয়েজিত রয়েছেন যা তাকে নিয়ে যাবে পর্দার ওপাড়ের পৃথিবীতে। তল শন্দটি ডাইমেনশনের বিকল্প নয় কিন্তু সহজ করে বোঝার প্রয়োজনে আমরা এটা ব্যবহার করতে পারি। আমরা জানি যে একটি ইটের ছয়টি তল রয়েছে, এগারটি তলের কথা আমরা সুস্পষ্টভাবে জানি কিন্তু গণিতজ্ঞগণ অসংখ্য তলের কথা বলেন। কিন্তু এটা সত্যই যে আমরা তলকে সংখ্যার হিসেবে প্রকাশ করতে পারিনা।
প্রকৃতি তার অভ্যন্তরে কতগুলো তল লুকিয়ে রেখেছে তা আমরা জানি না হয়তো কোনদিনই জানবো না। কারণ প্রকৃতি তার সব নিয়ম মানুষকে জানতে দেবে না।

বাস্তব জগতের কোন উদাহরণ দ্বারা আমরা  ডাইমেনশনকে পুরো মাত্রায় বুঝতে পারি না, যেমন ঘড়ির সময় দেখে মহাজাগতিক সময়ের রহস্য জানা যায় না তথাপি অনুধাবনের প্রয়োজনে বাহ্য কিছু উদাহরণ সহায়তা করে থাকে। ইটের ছয়টি তল, প্রতিটি তল বা স্থান একটি অপরটির থেকে পৃথক, অথচ তারা একটি বস্তুতে বর্তমান। যদি ছয়টি ক্ষুদ্র প্রাণী ছয়টি তলে বসে থাকে তবে তারা পরস্পরের কাছে অদৃশ্য হয়ে থাকবে কিন্তু তারা পাশাপাশি অবস্থান করছে। আর একটি উদাহরণের দ্বারা বিষয়টি বোঝা যেতে পারে, ধরা যাক একটি লোক নৌকায় বসে রয়েছে , তার নিচে গভীর জলরাশি, সেই জলবাশির নিচে রয়েছে আর একটি দুনিয়া যেখানে রয়েছে অসংখ্য জীবজন্তু। বিশাল অদৃশ্য দুনিয়াটি নৌকার লোকটির চেয়ে বড় তারপরও সেটা দৃষ্টির আড়ালেই রয়েছে কিন্তু তার অস্বিত্বকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। একটা মহাজাগতিক পর্দা আমাদের দুনিয়াকে অপরাপর বিশ্ব  থেকে আলাদা করে দিয়েছে। আমরা যেন বোতল বন্দী একটি পোকা যে তার বোতলটিকেই মহাবিশ্ব ভেবে মহাতৃপ্ত। যে জানে না সে মূলত প্রকৃতির গোলক ধাঁধার আবর্তে রয়েছে। সে যদি বোতলের গায়ে একটা ছিদ্র করতে পারে তবে সে ভিন্ন একটা ডাইমেনশনে পৌঁছবে যেটা তার বিশ্ব থেকে ভিন্ন একটা বিশ্ব । ড.নির্ঝর তার সহকর্মিনী জেরিনকে বললেন, আমার বিশ বছরের সাধনা সমাপ্ত হতে  চলেছে। মানব জাতির জন্য এটা একটা বড় অর্জন। এর মাধ্যমে তারা সময়কে জয় করবে, স্থানকে জয় করবে। একে একে তারা সকল ডাইমেনশন গুলোকে জানবে আর নিজের ছোট ঘরের ভেতরেই আবিষ্কার করবে ভিন্ন ভিন্ন জগত। প্রকৃতি আমাদের চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে একটা অদৃশ্য পর্দা সেই পর্দাটির মধ্যে যদি একটা ছিদ্র করা যায় এবং চোখ রাখা যায়  তবে দেখতে পাব আরো অসংখ্য জগত।
জেরিন বললেন, আমি এখনো ডাইমেনশন জিনিসটি বুঝতে পারিনি। সেই অদৃশ্য পর্দাটি কোথায় খুঁজে পারেন আপনি । এটা যেন ভবিষ্যতে যাবার চেষ্টা, যে দরজা প্রকৃতি বন্ধ করে রেখেছে। স্টিফেন হকিং এর কথা স্মরণ করুন, তিনি  বলেছেন,  আমরা অতীত বা   ভবিষ্যতে যেতে পারব না। সেটা  কখনই সম্ভব নয়। 
আমি ভবিষ্যতে যেতে চাই না। ড. নির্ঝর বলেলেন, ভিন্ন জগতে যেতে চাই। গাণিতিক সমস্ত হিসেবে আমি সম্পন্ন করে এনেছি। আমার এই বিশাল যন্ত্রটা  থেকে নির্গত রশ্মি একটা ওয়ার্ম হোল খুঁজে নেবে, সেই ওয়ার্ম হোলের মধ্য দিয়ে এটা আমাকে পাঠিয়ে দেবে আলাদা একটা জগতে, হয়তো সেই জগতটা এই ঘরেই রয়েছে, হয়তো বিশ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ডায়নোসররা এখনো চরে বেড়াচ্ছে আমাদের এই ঘরেই। তারা বেঁচে থাকতে পারে কারণ তারা আমাদের পৃথিবীতে নয় ভিন্ন কোন পৃথিবীতে রয়েছে।
জেরিন বললেন, আপনার এই আজব যন্ত্রটা দেখে আমি ভীত, বছরের পর বছর এটা নির্মানে আপনার সঙ্গ দিয়েছি, এটা না  জেনে যে এটি আসলে কি কাজে দেবে, সময় ভ্রমনের এমন একটা যন্ত্র আমরা তৈরি করেছি যেটা কোনদিন কাজ করবে না, কারণ কল্প কথায় যা হয়  বাস্তবে তা হয় না।
জেরিন আরও বললেন , ওয়ার্ম হোলের বিষয়ে পৃথিবীর সকল বিজ্ঞানী এখনো নিশ্চিত নন, এটা এখনো প্রাক্-তত্ত্ব  পর্যায়ে রয়েছে । ওয়ার্ম হোলের  খোঁজে  এমন একটা যস্ত্রে  উঠে বসা উচিত নয় যেটা আপনাকে মেরে ফেলতে পারে, এর রেডিয়েশন আমরা জানি না কতটা প্রভাব ফেলবে। আমরা আরও ধৈর্য ধরতে পারি।
ড.নির্ঝর বললেন, আমি চাইনা আমার পূর্বে আর কেউ এই বিশাল আবিষ্কারের সম্মান পায়, আমি জানি পৃথিবীর অনেক দেশের বিজ্ঞানীরা ওয়ার্ম হোল অনুসন্ধানে অনেকটা এগিয়েছে।
 জেরিন বললেন, ভেবে পাই না, এই ঘরের ভেতরে আপনার যন্ত্রগুলো ওয়ার্ম হোল খুঁজে পাবে কিভাবে ? এটা পাগলামি ।
--এর রশ্মিগুলো ছুটে যাবে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত। বক্র হয়ে যাওয়া স্থানের মধ্যে ওরা সীমাহীন দূরত্ব অতিক্রম করবে কিন্তু রশ্মিগুলো ঘরের মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে। হাজার মাইল দীর্ঘ একটা কাপড়কে যেমন ছোট্ট একটা জায়গায় আবদ্ধ  করে রাখা যায়, স্থানও তেমনি বক্র। তাই ছোট্ট একটা স্থানেই একাধিক জগত থাকতে পারে। হয়তো আকাশের তারাগুলো আমাদের অনেক কাছেই রয়েছে, হয়তো তোমার আমার মধ্যবর্তী দূরত্বের চেয়েও ওদের দূরত্ব কম। হতে পারে তুমিই তারাদের  চাইতে বেশি দূরে রয়েছ। বক্রস্থান আমাদের নিকটবর্তী করেছে।  ড. নির্ঝর তার যন্ত্রটি শেষবার পরখ করে নিতে নিতে বললেন ,ফলাফল যাই হোক প্রচেষ্টার জন্য মানুষ আমাকে মনে রাখবে। হয়তো তুমিও ভুলবে না।
 ড.নির্ঝর যন্ত্রে উঠে বসলেন, শেষবারের মত দেখে নিলেন তার চারপাশটা, এটাই শেষ, মূত্যুকেই হয়তো তিনি বেছে নিলেন বিজ্ঞানের এমন একটা তত্ত্বের জন্য যা এখনো প্রমাণিত নয়।
আর একটা কথা, তুমি কিন্তু বেশ মেয়ে,তুমি শুধু কাজ করনি আমাকে ভালবেসে এসেছ।
--হ্যাঁ,ভিন্ন ডাইমেনশনের ভালবাসা সেটা।
ড. নির্ঝর হেসে বললেন, হ্যাঁ তাই।
ড.নির্ঝর যন্ত্র থেকে নেমে এসে জেরিনের  হাত ধরলেন, তার সজল চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, মূত্যু বলে কিছু নেই, আমরা হলাম বেলাভূমিতে পড়ে থাকা পাথরের মত, যেখানে ছুঁড়ে ফেলবে, সেখানেই সে অবস্থান করবে। আমিও মহাশুন্যের বেলাভূমির কোথাও না কথাও থাকবো। হয়তো থাকবো তোমার নিকটেই অথবা কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে।
ড. নির্ঝর যন্ত্রটায় উঠে বসলেন, চালিয়ে দিলেন সেটা,চোখের অদৃশ্য রশ্মিগুলো ছুটে গেল শত শত আলোকবর্ষ ব্যাপী দীর্ঘ পথ। একটা ওয়ার্ম হোল খুঁজে পেল তারা, ড. নির্ঝর সেই পথে চলে গেলেন ভিন্ন একটা দুনিয়ায়। যন্ত্রটা থেমে গেল, জেরিন শুণ্য আসনটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তবে সবকিছুই মিটে গেল, জেরিন ভাবলেন, ড. নির্ঝর এখন কোথায়! এখানেই অথবা ছায়াপথের অন্য কোন গ্রহে নাকি আরও দূরে ভিন্ন কোন গ্যালাক্সিতে। অথবা তিনি পৃথিবীর প্যারালাল কোন পৃথিবীতে পৌঁছে গেছেন যেখানে মানুষ এখনো আদিম পর্যায়ে রয়েছে অথবা ডায়নোসরদের মাঝে বিপন্ন  অবস্থায় রয়েছেন, একটা আশ্রয়ের জন্য হণ্যে হয়ে ঘুরছেন। অথবা মহাশুণ্যে শিলাখন্ডের মত জড় পদার্থ হয়ে ভাসছেন।
জানি না, জেরিন বললেন। রাত্রি হয়ে এলে তিনি বাড়ির ছাদে এসে দাঁড়ালেন, অগণিত তারা জ্বলছে আকাশে। ড. নির্ঝর এখন কোথায়! কেউ জানে না। জেরিন ড. নির্ঝরের কথাটি সশব্দে বললেন, আমরা সবাই বেলা ভূমির পাথরের মত, কোথাও না কোথাও আমরা অবস্থান করি।


আরো পড়ুন--