বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০১৪

গণসেবক-(প্রহসন)


                                                              চার্বাক সুমন
‘জনগণ’ হইল ঊনবিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার, কহিলেন গণসেবক ।
ইহা কিরূপ প্রকারে হইতে পারে? তৎকালে বিপুল পরিমাণ মহামানবেরা দর্শন দান করিয়াছেন, জনৈক সভ্য ভীতি বর্জন করিয়া কহিলেন, ‘জনগণ’  কী প্রকারে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হইল? -তাহা অনুধাবন করিতে ব্যর্থ হইলাম।

--তৎকালে বৃহৎ বৃহৎ জ্ঞানী আসিয়া স্কুল বালকদিগের বাড়ির কাজ বাড়াইয়া দিয়াছেন, ইহাতে বালকদিগের তৎপরতা বাড়িয়া গিয়াছে-বিপরীতক্রমে মাস্টরদিগের বেতন নিম্নগামী হইয়াছে, কহিলেন গণসেবক, তাহাতে সমাজ আগাইয়া গিয়াছে-রাজনীতিকগণ কর্মমূখর হইয়াছেন; তথাপি শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারের সম্মান উহাদিগের প্রাপ্ত হইল না।

--আমাদিগের মস্তিষ্ক উত্তম প্রকারে ক্রিয়া না করিবা হেতু পুনরায় অনুধাবনে ব্যর্থ হইলাম, কহিলেন অপর জনৈক সভ্য,ভাবিয়া দেখুন অষ্টাদশ -ঊনবিংশতি শতকে বিশ্বব্যাপীয়া জ্ঞানীগণের আগমন হইয়াছিল; বোধ করি বিধাতা ভ্রমবশত এককালে সকল মনীষীগণকে প্রেরণ করিয়া থাকিবেন। তাহারা সাহিত্য করিয়াছেন, দিক্ দর্শন করাইয়াছেন, বিজ্ঞান-সূত্র দান করিয়াছেন, কেহবা রাজনীতি করিয়া আজি অমরলোক প্রাপ্ত হইয়াছেন।

কিন্তু ইহাদিগের কেহই ‘জনগণ’-নাম্নী কোন বস্তু বা সূত্র দিয়া গিয়াছেন বলিয়া বোধ করিতে পারি না। অজ্ঞের অক্ষমতা মার্জনা হয়।
গণসেবক অজ্ঞ সভ্যকে মার্জনা করিলেন পর বক্র সংকট ঋজু করিতে থাকিলেন, তুমি ভ্রম করিতেছ; প্রথমত: জনগণ বস্ত নহে, দ্বিতীয়ত: উহা বিজ্ঞানের সূত্রও নহে। ইহা হইল যুগের মহান আবিষ্কার তাহার তুলনা অন্বেষণ করিয়া মিলিতেছে না।
গণসেবক নানাবিধ প্রকারে জনগণের পরিচয় দান করিলেন, তাহার উপযোগিতা ব্যাখ্যা করিলেন, এই সকল বিশ্লেষণ শ্রবণ করিয়া সভ্যগণ বিভ্রান্ত হইয়া নানাবিধ কৌতূহল প্রকাশ করিতে থাকিলেন-

--জনগণ কি তাহা হইলে বস্তু বিশেষ?
--জনগণ  তবে বিজ্ঞানের সূত্র বোধ হইতেছে ।
--ইহা হইতে পারে ব্রহ্ম সদৃশ অজ্ঞেয় সত্ত্বা। পঞ্চ ইন্দ্রিয় ইহার মহিমা প্রকাশ করিতে পারে না।

--ইহা আগ্নেয়গিরি যাহা হইতে কেবল শক্তি নির্গত হইতে থাকে।
গণসেবকের বক্তৃতা শ্রবণ করিয়া সভ্যগণ বিভ্রান্ত হইয়া বিবাদে জড়াইয়া পড়িলেন, জনগণ কিরূপ হইতে পারে তাহার খসড়া তৈয়ার করিতে লাগিলেন এবং গণসেবকের নিকট তাহারা জনগণের ভিন্ব ভিন্ন জাগতি ও পারত্রিক আকৃতি পেশ করিলেন। তাহা অবলোকন করিয়া গণসেবক কহিলেন, তোমাদিগকে সমঝাইতে গিয়া অকারণ কাল ক্ষেপণ করিলাম।
উঠিয়া আইস –চাক্ষুষ করিবে।

গণসেবক সভ্যগণকে লইয়া বাতায়ন সন্নিকটে গমন করিলেন, উহার আবরণ -বস্ত্র অপসারণ করিয়া দিলে অপরাহ্নের শীতল সমীরণ আসিয়া তাহাদিগের প্রাণ জুড়াইয়া দিল। গণসেবক কৃষিক্ষেত্র পানে চাহিয়া কী এক বস্তু অন্বেষণ করিতে থাকিলেন, তাহার নজরে পড়িল বর্ষার সুগন্ধহীন কর্দম, কতিপয় হালের বলদ এবং কর্ষণজীবীগণের কতিপয় নিরীহ  ছাগু।

--জনগণ দেখিবে আইস, কহিলেন গণসেবক, খেতের পানে চাও-জনগণ দেখিতেছ কি?
--নজরে পড়িতেছে না মহোদয়, জনগণ নাম্নী কোন বস্তু নজর কাড়িল না ।
অতঃপর গণসেবক তর্জনী দ্বারা সকল বিষয় স্পষ্ট করিয়া দিলেন; তাহার তর্জনী অনুসরণ করিয়া সভ্যগণ অবলোকন করিলেন যে, ক্ষেত্র প্রান্তে ‍দুর্দন্ধযুক্ত কর্দম হইতে পদযুগোল বলপূর্বক  নিষ্কাষণ করিতে করিতে জনৈক অস্তি-চর্ম সার ব্যক্তি আগাইয়া আসিতেছে ; উহার কেশ বোতল রঙ ধারণ করিয়াছে, বক্ষভ্যন্তরস্থ অস্থি দৃশ্যমান রহিয়াছে, গাত্রবর্ণ মসীসদৃশ, পরিধানে দৃষ্টিগোচর হইতেছে লুঙ্গি, মস্তোকপরে ছিন্ন –গন্ধযুক্ত গামছা সর্পরূপ কুণ্ডলাকার ধারণ করিয়া শোভা নাশ করিতেছে।

গণসেবক উহার পানে অঙ্গুলি প্রসার করিয়া কহিলেন, এই হইল  জনগণ।
--আজি এক অদৃষ্টপূর্ব জন্তু দর্শন করিয়া ধন্য হইলাম। সভ্যগণ কহিলেন, কিন্তু বিস্ময়বোধ করিতেছি ইহা কী প্রকারে হেথায় আগমন করিল! কোনকালে এইরূপ প্রাণী দৃষ্টিগোচর হয় নাই। তবে ইহা কী প্রকারে আগমন করিল? ইহা কি বাংলার নিজস্ব ফ্লোরা –ফাউনা অথবা ভারত হইতে আগমন করিয়াছে?-যেরূপ প্রকারে থাকিয়া থাকিয়া ভারত হইতে চিতা কিংবা মেছো বাঘ সীমান্ত পার হইয়া আসিয়া পড়ে এবং পাবলিক উহাদিগকে পিটাইয়া পটল তুলিতে প্রেরণ করিয়া থাকে। -ইহা কি হইতেছে অনুরূপ প্রাণী?

--তাহা নহে , কহিতে থাকিলেন অপর সভ্য, এশিয়া দেশে এই রূপ প্রাণী কভু দৃষ্টি মধ্যে প্রবেশ করে নাই। সেই হেতু আমি নিশ্চয় করিয়া কহিতেছি যে, ইহা অবশ্যই আফ্রিকা বা চিন দেশীয় জঙ্গল হইতে আসিয়াছে।

--মাপ করিবেন গণসেবক মহোদয়, জনৈক সভ্য কহিলেন, ইহা কী বস্তু আহার করিয়া বাঁচিয়া থাকে?



--ইহার খাদ্য পত্র- ধান্য, এবং তাহা স্বয়ং উৎপাদন করিয়া থাকে।
--বিস্ময় প্রকাশ করিলাম –এরূপ কোন জন্তু আজিও প্রত্যক্ষ করি নাই যাহা আপনার ভোজ্য স্বয়ং উৎপাদন করিতে পারে।
--ইহাই সত্য, ইহা কম আবিষ্কার নহে- ইহা সর্বকালের সেরা আবিষ্কার-ভাবিয়া দেখ মনে-ইহা আপনার খাদ্য স্বয়ং সংগ্রহ করিয়া লইতেছে উপরন্তু আমাদিগকেও লাভবান করিতেছে। ইহার পালনে কোন ক্ষতি নাই।
--আপনি ইহাকে পালন করিয়া থাকেন! আফ্রিকার বন হইতে আসিয়াছে যে প্রাণী তাহাকে পালন করা সুসাধ্য নহে। মাপ করিবেন গণসেবক মহোদয়, আর একটি বিষয় জানিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছি-ইহা কী হিংস্র? শুনিয়াছি, যে প্রাণীর যত গভীর বনে বাস সে তত হিংস্র হইয়া উঠে। ইহার বিষয়ে কী মত প্রকাশ করিবেন?
--ইহা কদাপি হিংস্র নহে, ইহা ছাগু অপেক্ষা নিরীহ প্রাণী । ছাগু যেরূপ ক্রোধ হইলে পত্র চর্বণ করিতে থাকে এবং ক্রোধ বর্ধিত হইলে পলায়ন করিতে তৎপর হয় ইহাও অনুরূপ আচরণ করিয়া থাকে। অতএব ভীত হইও না, ইহার তীক্ষ্ন দন্ত নাই; তীক্ষ্ন –বলবান থাবা হইতেও স্রস্টা ইহাকে বঞ্ছিত করিয়া আমাদিগের নিরাপত্তা বিধান করিয়াছেন।

এই মহান দান হেতু স্রস্টাকে বারংবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি-তাহার করুণার শেষ নাই। তিনি ডাব মধ্যে দিয়াছেন সুস্বাদু পানীয়, জীব মধ্যে মাংস, ফল মধ্যে সুরা, নারী মধ্যে মদিরা-আর কী চাহ! ইহাই কী যথেষ্ট নহে-হে অকৃতজ্ঞ মানব সন্তান?
--উহাকে আরও নিকটবর্তী হইয়া প্রত্যক্ষ করিব। কহিলেন সভ্যগণ
--লাঠিয়াল প্রেরণ করিতেছি তবে । কহিলেন গণসেবক মহোদয়, এখনই ধরিয়া আনিবে।
--মহোদয়, পুনরায় বিস্ময় প্রকাশ করিতেছি; লাঠিয়াল কোথা হইতে আসিল?-উহারা তো ঊনবিংশ শতকে বিলোপ হইয়াছে, আজি তাহারা সহজ লভ্য নহে। তাহারা হইল আর এক আজব প্রাণী-। বোধ করিতেছি উহাদিগের বংশ লোপ পায় নাই। কিংবা টাইম মেশিন দ্বারা কতিপয় আমদানি করিয়া আনিয়াছেন।
--ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করিতেছ-ইহারা লাঠিয়াল নহে, ইহারা ততোধিক ভয়ানক প্রজাতি, মধুমক্ষী যেরূপ রাণীকে ঘিরিয়া রক্ষা করিয়া থাকে উহারাও অনুরূপ গণসেবকদিগকে হেফাজত করিয়া থাকে।

রক্ষক আসিয়া উপস্থিত হইলে গণসেবক তাহাকে মাঠ মধ্যে জনগণ দেখাইয়া ধরিয়া আনিতে আদেশ করিলেন, শিকারীর আদেশ পাইলে হাউণ্ড আহ্লাদিত হইয়া ওঠে; রক্ষক তদ্রুপ আমোদ প্রাপ্ত হইয়া ক্ষেত্র পানে ধাবিত হইল, কিয়ৎকাল অতিক্রান্ত হইলে রক্ষক জনগণের কণ্ঠে রজ্জু বন্ধন করিয়া  হাজির করিল।

রক্ষক কহিল, ইহা বড় নচ্ছার প্রাণী আছে, কেবল পলায়ন করিতে চাহে, যেদিক পানে রজ্জু টানিবেন –ইহা তাহার উল্টা পানে ধাবিত হইতে চাহিবে। ইহা ছাগুর স্বভাব প্রাপ্ত হইয়াছে। হইতে পারে উহারা ছাগুর সগোত্র হইতে বিবর্তনের রজ্জু ধরিয়া নামিয়া আসিয়াছে। ছাগু সকল কী প্রকারে ফেসবুক হইতে মাঠ মধ্যে আসিল ভাবিয়া পাইলাম না!  দুষ্ট বালকগণ  অধিক পরিমান ডাউনলোড করিয়া থাকিতে পারে।
অতঃপর সকলে মিলিয়া জনগণকে নিরীক্ষণ করিতে থাকিলেন, এবং সকলে এক মত হইলেন যে আরও অধিক পরিমাণে ইহার আবাদ করিতে হইবে; বঙ্গদেশ ইহাদের আবাদ করিবা হেতু যথেষ্ট উর্বর হইয়া আছে।  উৎপাদন সন্তোষজনক হইলে বৈদেশিক মুদ্রাও আসিবে।   

কতিপয় সভ্য অতিমাত্রায় উৎসাহিত হইয়া জনগণের ফটো তুলিয়া সংবাদপত্রে প্রকাশ করিয়া দিলেন; ইহাতে দেশবাসী আতঙ্কিত হইল এবং কর্মব্যস্ত শাসকগণ নড়িয়া চড়িয়া বসিলেন, ভাবিলেন , এ কী নতুন আপদ আসিয়া হাজির হইল!
জল্পনা –আলাপন-বিবাদ চলিতে লাগিল সর্বত্র। তত্ত্বানুসন্ধানে কতিপয় সংবাদ প্রণেতা গণসেবকের দ্বারে আসিয়া উপণীত হইলেন, প্রকৃত সত্য উদঘাটন করিয়া দেশবাসীকে ভীতি মুক্ত করিবেন এই হইল তাহাদিগের সৎ প্রয়াস। সৎ প্রয়াস লইয়া তাহারা গণসেবকের নিকট উপস্থিত হইলে পর গণসেবক মহোদয় তাহাদিগের আগমনের হেতু উত্থাপন করিলেন।

জানিতে পারিয়াছি আপনি আফ্রিকা হইতে এক ভীতিকর জন্তু লইয়া আসিয়াছেন, সাংবাদিক কহিতে থাকিলেন, উহার বিষয়ে জানিতে ইচ্ছা করিতেছি। উহা কি প্রকারে বঙ্গ সীমায় প্রবেশ করল এবং ইহা প্রজাতন্ত্রের নাগরিকগণের  জানমালের কী পরিমাণ হানি ঘটাইতে সক্ষম-জানিতে ইচ্ছুক।

ভ্রম করিতেছেন, কহিলেন গণসেবক, ইহা আফ্রিকা বা আমাজানের জঙ্গল হইতে আমদানি হয় নাই। ইহা সম্পূর্ণ দেশীপণ্য। স্বদেশে আপনা আপনি গজাইয়া উঠিয়াছে, আমি কেবল ইহার পরিচর‌্যা করিতেছি।

ভাবিয়া দেখুন শত-সহস্র বৎসর হইতে প্রেজাতন্ত্রের মৃত্তিকায় স্বতঃসিদ্ধ হইয়া গজা্ইয়া উঠিতেছে ওষুধি বৃক্ষ সকল, বনে বাদারে জন্ম লইতেছে কত প্রাণী –জীব কূল; তাহারা আমাদিগকে কী না দিতেছে-মাংস, মাৎস, ওষুধ, বাহারি খাদ্য ও পানীয়।
‘জনগণ’ অর্বাচীনকালে আবিষ্কার হইলেও ইহার গুরুত্ব অপরিসসীম-।ইহা আমাদিগকে সকল বস্তু যোগাইয়া থাকে, ইহা স্বয়ং আহার করে অল্প-দান করে বেশি-ইহা শ্রেষ্ঠ আবিস্কার না হইয়া পারে না।

--কিন্তু কী করিয়া নিশ্চিত হইব যে উহারা প্রজাতন্ত্রের নিকট দুঃস্বপ্ন বলিয়া বোধ হইবে না। স্বচক্ষে দর্শন করিলে অনুধাবন করিতে সক্ষম হইতাম।
সংবাদ প্রণেতাগণের অনুরোধক্রমে গণসেবকের আদেশে একটি ‘জনগণ’ তাহাদিগের সম্মুখে আনীত হইলে পর সকল জনের চক্ষু তাহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। অকস্মাৎ জনৈক সংবাদ প্রণেতা বলিয়া উঠিলেন, মনে পড়িয়াছে-ইহা হইল জনগণ-ইহার আবিষ্কারক গণসেবক মহোদয় নহেন –ইহার আবিষ্কারক হইল সংবাদ প্রণেতাগণ!
ভাবিয়া দেখুন এককালে জনগণ বলিয়া কোন প্রাণীকে প্রজাতন্ত্রবাসী চিনিতেন না, আমাদিগের পূর্বজ সংবাদ সংগ্রাহকগণ ইহা আবিষ্কার করিয়াছেন। আমরাই হইলাম ইহার আবিষ্কারক!

--অনুধাবনে ব্যর্থ হইলাম, কহিলেন গণসেবক মহোদয়
--অনুসন্ধান করুন অষ্টাদশ শতকের পূর্ববর্তী পত্র সমূহ, জনগণ কোন স্থানে মিলিবে না। অতঃপর কালের চাহিদা বিচার করিয়া ইহাকে বিশ্ববাসীর সম্মুখে আনিয়া হাজির করিয়াছি।  ইহা অসত্য না হইলে  কাহার দাবী অগ্রবর্তী হইবে?
কৃতিত্ব হস্তচ্যুত হইতেছে দেখিয়া গণসেবক বিপন্নবোধ করিলেন এবং বক্তৃতা করিয়া কহিলেন, বিষ্ণু সর্বদা ব্রহ্মার অধিক মর‌্যাদা পাইয়া আসিয়াছেন কারণ হইল পালন কর্তা জন্মদাতার অনুপাতে ক্ষুদ্র নহেন, ইহা যদি সত্য হইল তবে আমি অধিক কৃতিত্বের দাবীদার হইলাম।

মস্তিষ্ক খাটাইয়া দেখুন –জনগণ আপনারা আবিষ্কার করিলে তাহাকে পালন করিয়াছে কে? আমি প্রজাতন্ত্রের গণসেবক-জনগণের পালন কর্তা, তাহাকে তিল তিল করিয়া গড়িয়াছি; উহাকে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার দিয়াছি কিন্তু কর্মের অধিকার দেই নাই। উপরন্তু সকল বিষয় সে স্বয়ং অর্জন করিয়া লইবে।
এবং তাহাকে সহায়তা করিয়াছি নানাবিধ প্রকারে-সর্বাগ্রে তাহাকে ভূমিহীন করিয়াছি, অতঃপর তাহাকে কর্মহীন করিয়াছি, তাইনা সে আজি উত্তম সেবক হইয়া পরকালের সুখ সন্ধান হেতু আমাদিগের সেবায় আত্মদান করিয়াছে।

--কিন্তুেউহা তো কেবল হাড়-চর্ম সার হইয়া উঠিয়াছে?
--কি করিব ওইরূপ না হইলে জনগণ হইল কী প্রকারে? উহাদিগকে তো সকল অধিকার দিয়াছি-অর্জন করিয়া না লইতে পারিলে কি করিব? গোশালায় বন্ধন করিয়া আম্র পত্র খাইতে দিব? তাহা হইলে আমার দর্শনের সহিত মিলিল না। কহিলেন গণসেবক, বুঝিলাম আপনাদিগকে বিষয়টি আরও খোলাসা করিতে হইবে।

গণসেবকের আজ্ঞা পাইয়া লেঠেলগণ শ্রম ক্লিষ্ট হইয়া একটি বংশ নির্মিত খাঁচা আনিয়া হাজির করিলেন-উহার অভ্যন্তরে কতিপয় প্রাণী অশান্তিসহ অবস্থান লইয়াছে এবং সুখ বা দুঃখ প্রকাশ হেতু কেবল প্যাঁক প্যাক করিতেছে ।
--গণসেবক মহোদয়, ইহা কী হইল? -ইহারা তো হইতেছে হংসশাবক , ইহাদিগকে কেন আনয়ন করা হইল! হংস শাবকগণ দুঃখ পাইয়া প্যাক প্যাক করিতেছে, উহাদিগকে ছাড়িয়া দিতে হইবে, আহা! হংস শাবকবৃন্দ—।
--আপনাদিগের চক্ষুরোগ কি প্রকারে হইল বুঝিতে অপারগ হইলাম, -মনোনিবেশ করিয়া নিরীক্ষণ করুন-

সংবাদ প্রণেতাগণ মনোনিবেশ করিয়া খাঁচা মধ্যে কতিপয় জনগণ দর্শন করিলেন, উহারা হংসশাবক সদৃশ বোধ হইলেও তাহারা হইল জনগণ। অতঃপর তাহারা আপনাদিগের ভ্রম অনুধাবন করিয়া মস্তক অবনত করিলেন। এবং জনগণ বংশ নির্মিত খাঁচা –বন্দী হইয়া 
প্যাঁকপ্যাঁক করিতে থাকিলেন।

আরো পড়ুন--



বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০১৪



লোকায়ত দর্শন-চার্বাক
চার্বাক সুমন

বলা হয় ভারতবর্ষ আধ্যাত্মিকতার দেশ এই সব আধ্যাত্মিক চিন্তার কিছু স্থানিক আর কিছু বিদেশাগত, আধ্যাত্মিকতার সুফল আমরা পেয়েছি-এর বেশিটাই ফলেছে শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক মননশীলতায় আবার শত শত বছর ধরে এর কুফল গুলোও বহন করে চলতে হচ্ছে আমাদের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার তার একটি, এতে রাজনীতি বিকশিত হয় না আর ধর্মও হয় কলুষিত; ধর্মীর খুঁটি ব্যতীত আমরা কোন কিছুই ব্যবহার করতে পারি না, এর  অনেক কারণ বিশেষজ্ঞগণ নির্দেশ করতে পারেন তবে এর অন্যতম একটি কারণ হল বাংলাদেশের অবস্থান ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর প্রান্তে বিদেশাগত সকলজনগোষ্ঠী এতদূরবর্তী স্থানে আসতে চায়নি, আর্যগণ ভারতবর্ষে ১৫০০ খ্রি. পূ. প্রবেশ করেছেন বলে অনেকে মনে করেন কিন্তু বাংলাদেশ পর্যন্ত তারা পৌঁছেছেন আরো এক হাজার বছর পরে , সেটা  **চতুর্থ খ্রি. পূ. এর দিকে বলে অনেকে মনে করেন 

বাংলাদেশের পশ্চাদপদতার এই এক বড় কারণ , রিজলের মত ঐতিহাসিকগণ এমনটাই মনে করেন বাহিরের জ্ঞান এখানে সর্বদা দেরিতে এসেছে, যা আমরা পেয়েছি তাও ছিল সীমিত, সময়ের সাথে সাথে তা আরো সীমিত হয়ে গিয়েছে আর এদেশের মানুষ কখনো বর্হিগামিও হয়নি;এদেশের শীতল আবহাওয়া, ঊর্বর ভূমি মানুষকে করেছে শান্তিপ্রিয়, আধ্যাত্মিক, অলসও বটে আর এই প্রকৃতির দানের মূল্য আমরা দিয়ে চলেছি যুগে যুগে এটা আশ্চর্য যে , যেসব জাতি এখানে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করেছে তারাও সময়ে তেজ হারিয়ে ফেলেছে, যোদ্ধা থেকে তারা কবিতে পরিণত হয়েছে আর আধ্যাত্মিক চিন্তাকে তারা যত সহজে গ্রহণ করেছে অন্য কোন চিন্তাকে অতটা সহজে গ্রহণ করেনি কিন্তু বস্তুবাদী চিন্তারও বিকাশ এখানে হয়েছে চার্বাক দর্শন তার একটি, বস্তুবাদী  দর্শনগুলো পূর্ণ বিকশিত না হওয়ার জন্যে সমাজ বিকাশও হয়েছে এক পেশে, আংশিক ধর্মের উন্মাদনা অনেকের মধ্যে থাকলেও ধর্মীয় সততা বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে নেইঅপর দিকে বস্তু দর্শন মানুষ গ্রহণ করেনি শুধু নয়, ধ্বংসও করেছে চার্বাক দর্শন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ

আজ চার্বাক দর্শনের কথা আমাদের শুনতে হয় অন্য কথকের মাধ্যমে, অনেকে চার্বাক দর্শনকে পরিপূর্ণ দর্শনের মর্যাদা দিতে চান না কিন্তু এটা সত্য নয় প্রথমত: চার্বাক দর্শনের মূল কোন পুস্তক পাওয়া যায়নি দ্বিতীয়ত: অপর যে সব শাস্ত্রে চার্বাক দর্শনের কথা পাওয়া যায় তাও পূর্ণাঙ্গ নয় বলেই ধরণা করা যায়
ঋগবেদ থেকে শুরু করে রামায়ণ, মহাভারত, ত্রিপিটক, মৈথিলি উপনিষদ, বিষ্ণপুরাণ, জৈন শাস্ত্র-এর মধ্যে চার্বাকদের সম্পর্কে বক্তব্য পাওয়া যায়, বলাই বাহল্য তার সবই নেতিবাচক এটা অবশ্য চার্বাকদের শক্তিশালী অবস্থানের কথা মনে করিয়ে দেয় পরবর্তীতে তাদের জনবিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, তাদের লিখিত পুস্তক নষ্ট করা হয়েছে বস্তুবাদী দর্শন বলতে ইউরোপের কথাই সবার মনে পড়ে, কিন্তু ভারতবর্ষের বস্তবাদ যে তাদের অগ্রবর্তী  এটা আমাদের কখনই আশ্বস্ত করে না কারণ এতে ধর্মনাশের আশংকা বিদ্যমান

ভারতীয় দর্শনগুলো মূলত ধর্মকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে, মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে পথ করে দেওয়াই ছিল এসব দর্শনের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু চার্বাক দর্শন লতার মত কোন আশ্রয় আঁকড়ে ধরেনি বরং সেটা স্বয়ং মহীরুহের মত দাঁড়িয়ে ছিল

ভাববদীদের চাপে চার্বাক দর্শন তার স্বতন্ত্র অবস্থান হারিয়ে ফেললেও তা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি, লোক সমাজে সব সময়ই এটা বর্তমান ছিল, হয়তো লোক সমাজেই হয়েছিল এর উদ্ভব সহজিয়া, বাউল, তন্ত্র, প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মধ্যে  চার্বাক দর্শনের প্রভাব রয়েছে
ভারতীয় দর্শন গুলোকে মোটাদাগে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়; এর একটি আস্তিক্যবাদী দর্শন অপরটি নাস্তিক্যবাদী দর্শন সাংখ্য, যোগ , ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা, বেদান্ত এই ছয়টি হল আস্তিক্যবাদী ষড়দর্শন চার্বাক, জৈন, বৌদ্ধ দর্শন হল নাস্তিক্যবাদী ত্রৈয়ী দর্শন এর মধ্যে চার্বাকই হল শতভাগ বস্তবাদী দর্শন, অপর দুটি দর্শন নাস্তিক্যবাদী হলেও ভাববাদের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠেতে পারেনি চার্বাক এসব দর্শনের পূর্বগামী হলেও বস্তুর বাইরে চিন্তা করেনি , প্রমাণ ব্যতীত যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের তারা ছিলেন বিরোধী

বহুল আলোচিত একটি পুস্তকের বিষয়ে বলাটা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে আশা করি বইটির নাম সিদ্ধার্থ লেখক হেরমান হেস অসাধারণ শিল্পগুণ সম্পন্ন বইটিতে হেরমান হেস মূলত বৌদ্ধ দর্শন তথা ভারতীয়  ভাববাদী দর্শনের সমালোচনা করেছেন বিষয়বস্ত এখানে সংক্ষেপে প্রণিধানযোগ্য ব্রাহ্মণপুত্র সিদ্ধার্থ--ধার্মিক, সদাচারী ,অনুসন্ধিৎসু তিনি সন্যাস নিয়ে সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পরলেন অনুসন্ধান করতে থাকলেন একজন উপযুক্ত গুরু এবং জীবনবাদী একটি দর্শনের কিন্তু গুরুগণ তাকে যা শেখালেন তাতে তিনি তুষ্ট হলেন না মোটেই; তিনি তার বন্ধুকে বললেন,তপস্যা কি?-প্রাণায়ামে কি হয়? এগুলো শুধু নিজের কাছ থেকে পালাবার চেষ্টা, অহং এর যাতনা থেকে সাময়িক পলায়নের চেষ্টা এটা হল গাড়োয়ানের ধেনো মদ পান করে কষ্ট ভোলার চেষ্টার মত

এভাবে সিদ্ধার্থ আচার সর্বস্ব ব্রাহ্মণ্য সংস্কারকে পেছনে ফেলে এলেন, তারপর সিদ্ধার্থ জনশ্রুতির দ্বারা চালিত হয়ে গৌতমবুদ্ধের নিকট এসে উপস্থিত হলেন,বুদ্ধের কৃচ্ছ্রসাধনের নীতিও তুষ্ট করতে পারল না তাকে আবার সামনে এগিয়ে চলা স্বগতোক্তি করলেন,এই দৃশ্যমান জগৎকে মায়া বলে উড়িয়ে দিয়েছি, নিজের চোখ জিহ্বাকেও বিশ্বাস করতে পারিনিআবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন সিদ্ধার্থ যেন পৃথিবীকে এই প্রথম দেখছেন পৃথিবী কত সুন্দর আর রহস্যময়, কিন্তু সিদ্ধার্থের নিকট অপরিচিত কত রঙের সমারোহ,-নীল, সবুজ, হলুদ; আকাশ, নদী, বন, পর্বত, সব সুন্দরময়, মনোমুগ্ধকর

এভাবেই সিদ্ধার্থের পুর্নজন্ম হল ধর্মের কৃত্রিম আচারানুষ্ঠানের পথ অগ্রাহ্য করে  জীবনকে র্জীবনের  পথে ছেড়ে দিলেন নদী পর্বত ত্যাগ করলে তার থাকে কেবল গতি, বৈচিত্র,আর জীবনকিন্তু হেরমান হেস তার সিদ্ধার্থকে কোন নির্দিষ্ট লক্ষে পৌঁছে দিতে সক্ষম হননি।উপন্যাসের শেষে দেখি সিদ্ধার্থ এক মাঝির সঙ্গে উদ্দেশ্যহীন কাল কাটাচ্ছেন,তার পত্রকেও দিতে পারেন নি কোন দিক নির্দেশনা;ফলে পিতার মত পুত্রও অনির্দেশের পথে অগ্রসর হয়।
 চার্বাক দার্শনিকগণও এমনি একটি জীবন দর্শনের কথা বলেছিলেন, তারা জীবনকে করেছিলেন জীবন মুখী, সকল প্রকার অন্ধবিশ্বাস , সংস্কার থেকে মানুষকে মুক্ত করেছিলেন
তারা মানুষকে রাক্ষস বৃত্তি অবলম্বন করতে বলেননি, বলেছিলেন জীবনবাদী আর বস্তুবাদী হতে চার্বাক দর্শনের অতি অল্পই আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে, হয়ত পূর্ণাঙ্গ দর্শনটিই আমাদের হাতে এসে পৌঁছত যদি সে সব ধ্বংস করা না হত চার্বক দর্শন সম্পর্কে আমরা এখন জানতে পারি সূত্র আকারে , সূত্রগুলোর মধ্যে বৃহস্পতি সূত্র মধবাচার্যের সূত্র প্রণিধানযোগ্য

বৃহস্পতি সূত্রঃ
.        পৃথিব্যাপতেজোবায়ুতিরি তত্ত্বানি
    ( পৃথিবী, জল,আগুন এবং বায়ু মৌল উপাদান)
.         তৎসমুদয়ে শরীরেন্দ্রিয় বিষয় সংজ্ঞা
( এই চারিটি মৌলিক উপাদানের সংমিশ্রণের ফলে শরীর, ইন্দ্রিয় এবং বস্তর উৎপত্তি হয়)
.        কিনোবাদিভ্যো মাদকশক্তিবৎ বিজ্ঞানম
( গুড়, তণ্ডুল,প্রভৃতিতে মাদকতা খাকেনা, কিন্তু ওই সমস্ত বস্ত দ্বারা সুরা প্রস্তত করলে মাদকতা জন্মে তেমনি বস্ত হতে চৈতন্যের উৎপত্তি
.        চৈতন্য বিশিষ্ট কায়া পুরুষঃ
( চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা)
.        কাম এবৈক পুরুষার্থঃ
(ভোগই জীবনের উদ্দেশ্য)
.       মরণ মেবপবর্গঃ
( মৃত্যুই একমাত্র মুক্তি)

১১*মাধবাচার্য বণিত সূত্রঃ
.        ভূমি ,অপ, অনল, অনিল এই চারিটি ভূত বা মৌলিক পদার্থ হইতেই চৈতন্য সৃষ্টি হইয়াছে

.         হরিদ্রা পিত বর্ণ, চুন শুক্ল বর্ণ; কিন্তু উভয়ে মিলিত হইলে তাহাতে রক্তিম বর্ণের উৎপত্তি হয় গুড়, তণ্ডুলে মাদকতা নাই, কিন্তু ঔসব দ্রব্য দ্বারা সুরা প্রস্তুত করিলে তাহাতে মাদকতা শক্তি জন্মে এই চারিটি মৌলিক দ্রব্যের সংমিশ্রণে তেমনি ভাবে চৈতন্য উপস্থিত হয়

.        স্বর্গ , নরক, মোক্ষ, আত্মা, পরলোক কিছুই নাই বর্ণাশ্রম ধর্মেরক্রিয়া আদৌ ফলদায়ক নয় প্রতারক এবং ধূর্তেরা বেদের সৃষ্টি করিয়া স্বর্গ, নরক, প্রভৃতি নানা প্রকার অলৌকিক পদার্থের কথা বলিয়া মানুষকে অন্ধ করিয়া রাখিয়াছে, জন সমাজের প্রবৃত্তি জন্মাইয়াছে এবং রাজাদের নিকট হইতে বিপুল পরিমান অর্থ লাভ করিয়াছে

.        অগ্নিহোত্র, বেদপাঠ, ত্রিদণ্ড ধারণ, ভস্মলেপন প্রভৃতি কার্য বুদ্ধিহীন এবং পৌরুষহীন লোকেদের উপজীবিকা মাত্র

.        ধূর্তদের বিশ্বাস; জ্যোতিষ্টোম প্রভৃতি যজ্ঞে যে জীবের বলিদান করে সে স্বর্গ লাভ করে ধূর্তেরা তবে আপন পিতামাতার স্বর্গ লাভের জন্য তাহাদিগকে শিরচ্ছেদ করে না কেন?

.       শ্রাদ্ধকর্ম দ্বারা যদি মৃত ব্যক্তির তৃপ্তি হয়, তবে কোন ব্যক্তি বিদেশে গমন করিলে তাহাকে পাথেয় দিবার প্রয়োজন কি?বাড়িতে তাহার উদ্দেশ্যে কোন লোককে ভোজন করাইলেই তো হয়

.         দান করিলে স্বর্গস্থিত ব্যক্তির যদি তৃপ্তি হয়, তবে প্রাসাদের উপরের তলায় অবস্থিত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে নিচে বসিয়া কিছু নিবেদন করিলে সে পায় না কেন?

.       যত দিন বাঁচিয়া থাক ঋণ করিয়া ঘি খাও ভস্মীভূত দেহ আবার কোথা হইতে ফিরিয়া আসে?
.        দেহাবসানের পর আত্মা স্বর্গলোক প্রাপ্ত হইলে তাহা হইলে শোকাকুল বন্ধুদের নিকট ফিরিয়া আসে না কেন?

১০.      ভণ্ড, ধূর্ত, নিশাচর এই ত্রিবিধ লোক একত্রিত হইয়া বেদ রচনা করিয়াছে অশ্বমেধ যজ্ঞশেষে মাংস আহারের অনন্তর যজমান পত্নীর অশ্বশিশ্ন গ্রহণ করিবে ইত্যাদি অশ্লিল বিষয়ও ওই সকল নিশাচর ব্যক্তিদের সৃষ্টি

চার্বাক নামক কোন মনীষীর অস্তিত্ব ছিল কি না সেটা আজ আর আমরা জানি না, এই নামে কোন ঋষি ছিলেন বলে ধারণা করা হয় যিনি  আর্য অনাযের্র সকল অযৌক্তিক বিশ্বাসকে অস্বীকার করে বস্তবাদী চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন চার্বাক যদি ব্যক্তি বিশেষ হন তবে তিনি আর্য কি অনার্য ছিলেন তা আমরা জানি না, তবে তিনি আর্য ধর্মেরই ব্যাপক সমালোচনা করেছেন, তিনি ব্যক্তি বিশেষ হলে অনার্য ছিলেন এমন ধারণা করাই সঙ্গত, আর্য- অনার্য বিবাদের সময় তারা পরস্পরের চিন্তাকে অস্বীকার করবেন এটাই স্বাবাবিক শাস্ত্রে বলা হয় দেবগুরু বৃহস্পতি দানবদের বিপথগামী করার 

জন্য এই ভোগবাদী দর্শন তাদের মধ্যে প্রচার করেছিলেন
পান, ভোজন তথা জাগতিক সুখ ভোগকে এনারা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন তাইচর্ব ধাতু থেকে চার্বাক এসেছে বলে অনেকে ধারণা করে থাকেন অর্থৎ এরা পাপ পূণ্যাদি ভোগ করেনআবার মনে করা হয়চারু+ বাক হতে চার্বাক এসেছে এরকম ধারণা করার কারণ হল চার্বাকগণ মিষ্ট মিষ্ট কথা বলেন যেমন ধরা যাক: ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ

চার্বাক দর্শন বলে যে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ যাকে প্রত্যক্ষ করা যায় না তার কোন অস্তিত্ব নেই প্রত্যক্ষ দুই প্রকার-বাহ্য প্রত্যক্ষ যা ইন্দ্রীয় দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায়; মানস প্রত্যক্ষ, যা মন দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায় যেমন: সুখ,দুঃখ বেদান্তের অনুমান শব্দকে চার্বাকগণ প্রমাণ হিসেবে মেনে নিতে চান না অনুমানকে চার্বাকগণ অভ্রান্ত সত্য বলে মেনে নেন না, এমনকি সেটা কার্য-কারণ সম্পর্ক দ্বারা সমর্থিত হলেও প্রৃকতপক্ষে তারা শতভাগ নিশ্চিত না হয় সিদ্ধান্তে যেতে চাইতেন নাঅর্থাৎ যা প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত তাকে মেনে নাও কিন্তু অপ্রত্যক্ষ কার্য-কারণ সম্পর্ক দ্বারা সমর্থিত হলেও তাকে সন্দেহের উর্ধ্ব রেখ না কারণ এখন আমরা যাকে কার্য-কারণ সম্পর্ক জ্ঞান করছি সেটা অন্যথাও হতে পারে ব্যপ্তিজ্ঞান ছাড়া যথার্থ অনুমান সম্ভব নয়, আগুন ধোঁয়ার সম্পর্ক হল নিয়ত এবং অব্যভিচারী , এই অবিচ্ছিন্ন সম্পর্কই হল ব্যপ্তি সম্পর্ক চার্বাকগণ বলেন যে, এই সম্পর্র্ক সন্দেহাতীত নয় কারণ আগুনের সাথে ধূমের সম্বন্ধ আছে কি না তা প্রত্যক্ষ করা যায় না দুটি বস্তু পাশাপাশি অবস্থান করলেই অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক বোঝায় না আবার কোন নিয়ত সম্পর্ক বর্তমানে প্রত্যক্ষগোচর হলেও অতীত, ভবিষ্যতে একই নিয়ম প্রযোয্য কিনা তা জানা যায় না যে অনুমান বর্তমানে সত্য অতীত ভবিষ্যতে সেটা একিই রকম নাও থাকতে পারে ব্যপ্তিজ্ঞান অনুমান নির্ভর হতে পারে না, কারণ অনুমান নির্ভর ব্যপ্তিজ্ঞান সন্দেহের উর্ধ্বে নয় আর অনুমান লব্ধ জ্ঞান আসে 

অন্যজ্ঞানের মাধ্যমে বা আপ্ত বাক্যের মাধ্যমে যা সুস্পষ্ট নয় বিধায় গ্রহণযোগ্য নয়                                             
 ইউরোপিয় দার্শনিক *হিউমও কার্য-কারণ সম্পর্ককে আকস্মিক যুগপৎ বলে উল্লেখ করেন তিনি বলেন  পাথর নিচের দিকে পড়ে এটা আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কিন্তু  নিয়মটিকে তো আমরা দেখি না, সাদা কাক দেখিনি বলে বলতে পারি না যে সাদা কাক নেই্ এখানে চার্বাকগণের জন্যে বলতে হয় যে,সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে তখনও কার্য-কারণ সম্পর্ক বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত ছিল না কার্য-কারণ সম্পর্ক ছিল অনুমান নির্ভর , আরোহ এবং অবরোহ অনুমান দ্বারা কার্য-কারনের ধারণায় উপণীত হতে হত তবে অষ্টাদশ শতকের মানুষ হিসেবে হিউমের(১৭১১-১৭৭৬) ভিন্নভাবে  চিন্তা করার সুযোগ ছিল
বৌদ্ধ দর্শন এবং অদ্বৈত দর্শনও অনুমানকে চরম প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে না তবে অভিজ্ঞতা সাপেক্ষে ব্যবহারিক জ্ঞানের অবলম্বন হিসেবে স্বীকার করে এই দর্শনগুলো পারমার্থিক জ্ঞানকে স্বতোপ্রামাণ্য বলে গ্রহন করে, কিন্তু চার্বাকগণ আপ্তবাক্য তো পরের কথা  কার্যকারণ সর্ম্পকেও মানতে চান না অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিতে চার্বাকগণ সমালোচনার সম্ম্খীন হন কারণ সকল জ্ঞান প্রত্যক্ষভাবে আসে না অনুমান ছাড়া চিন্তা, আলোচনা, বিচার বিশ্লেষণ তত্ত্ব সম্বব নয় অনুমান সকল ক্ষেত্রে সত্য না হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে এর প্রয়োজনকে অস্বীকার করা যায় না

কোন জ্ঞানই প্রারম্ভিক পর্যায়ে  সীমাবদ্ধ থাকে না চার্বাক দর্শনও বিবর্তিত হয়েছে এবং শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছেঅর্বাচীন চার্বাকগণ এই দর্শনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছিলেন তারা অতীতের প্রতি উদ্দিষ্ট অনুমানকে স্বীকার করেন, অতীতের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ মুলক ভিত্তি থাকে কিন্তু ভবিষ্যতের প্রতি উদ্দিষ্ট অনুমান অনিশ্চিত বলে গ্রহণযোগ্য নয়

কল্যাণ বা উদ্দেশ্যবাদ চার্বাক দর্শনে স্বীকার করা হয় না তারা বলেন,সৃষ্টি,পরিবর্তন, বিবর্তনের মূলে কারো কল্যাণ চিন্তা বা উদ্দেশ্য নেই সমস্ত ঘটনা যুগপৎ, অনিশ্চিত এবং আকস্মিক  সুখই জীবনের মূখ্য (সুখমেব পুরুষার্থঃ) সুখই স্বর্গ, দুঃখই নরক, মৃত্যুই মোক্ষ কাঁটার ভয়ে যেমন মাছ বর্জন করা বোকামি তেমনি দুঃখের ভয়ে বনবাসে গিয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করাও বোকামি পদ্মবনে কাঁটা আছে , জীবনে দুঃখ আছে

চার্বকগণ চেতনাকে স্বীকার করেন তবে এটাকে কোন আলাদা সত্ত্বা হিসেবে মানেন না তাদের মতে চেতনা দেহেরই একটি গুণ পান, চুন, এবং সুপারি এই তিনটি বস্তুর কোনটির মধ্যে লাল রং নেই, তবু এই তিনটি বস্তকে একসাথে চর্বন করলে লাল রঙের আবির্ভাব ঘটে

চার্বকগনণ পরমণুর অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না, কেননা পরমাণুকে দেখা যায় না, আকাশরূপ বস্ততেও তাদের অবিশ্বাস কারণ তা প্রত্যক্ষ করা যায় না তাই  স্বর্গ নরকে আদের বিশ্বাস নেই্ পরমাণুর ধারণা কণাদ দিয়েছেন ৫০০ খ্রি.পূ,সময়ে ডেমোক্রিটাস দেন ৪৬০-৩৭০ খ্রি.পূ  সময়ের মধ্যে লিউসিপাসও পরমাণুর ধারণা দেন কাছাকাছি সময়ে।চার্বাক দর্শন এক্ষেত্রে এগিয়ে একারনে যে,চার্বাক পান,সুপারি ও চুনের মিশ্রণে লাল বর্ণ উৎপন্ন হওয়ার বিষয়টিকে দেখেছিলেন বিক্রিয়া হিসেবে আবার গুড়,ফলের রস হতে মদ তৈরির উদাহরণটিও বিক্রিয়ার কথাই মনে করিয়ে দেয়্। কিন্তু ডেমোক্রিটাসের পরমানু দ্বারা পদার্থ নির্মান হল কেবল পরমাণুর স্তর বিন্যাসের ধারণা-বিক্রিয়া নয়।
কার্য-কারণ সম্পর্কের মত পরমাণুর ধারণা চার্বাকগণের গ্রহণ না করার কারণ হল তখনও পরমাণু তত্ত্ব যথেষ্ট বিজ্ঞান সম্মত ভিত্তি লাভ করেনি

চার্বাকগণ আত্মার ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না, তাদের মতে চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা অর্থাৎ দেহ আত্মা অভিন্ন মোক্ষে তাদের বিশ্বাস নেই, মৃত্য হচ্ছে এক মাত্র মোক্ষ পুনর্জন্মে তারা বিশ্বাসী হবেন না এটা বলাই বাহুল্য ভস্মীভূতদেহ পুনরায় কর্মফল ভোগের জন্য ফিরে আসে এটা গ্রহণযোগ্য নয় আজ আমরা জানি যে *জন্মান্তরের বিশ্বাসটি কোম ভিত্তিক সমাজের সৃষ্টি
   
চার্বাক দর্শন কি নীতিহীন ভোগবাদী দর্শনমাত্র ? এটা ভেবে দেখার অবকাশ আছে যে পরবর্তী ষড়- দর্শনের ভাবের রাশ টেনে ধরেছিল চার্বাক, নইলে দেব-দেবতাদের গুণকীর্তণ আজও হয়ত শেষ হত না চার্বাবগণ বস্তুবাদী দৃষ্টিতে পথপ্রদর্শন করেন; তারা বাকির লোভে নগদ ছাড়তে নারাজ ( লালন ফকিরের গীতি স্মরণীয়) গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাসের নৈতিক মতবাদের সাথে চার্বকের নৈতিক মতবাদের মিল রয়েছে চার্বাকগণ শুধু  ভোগের কথাই বলেন নি, দায়িত্বের কথাও বলেন, আসলে দায়িত্বহীন মানব সমাজের অস্তিত্ব সম্ভব নয় বস্তুবাদে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোই সমৃদ্ধরাষ্ট্র বৃহস্পতির সামাজিক ন্যায় বিচার সম্পর্কে সূত্র রয়েছে:

রাজাকে জন সমর্থিত হতে হবে ( লোক সিদ্ধ ভবেৎ রাজা) চার্বাক দর্শনে, বর্ণভেদকে স্বীকার করা হয়নি, চার্বাক দর্শনই মূলত ভারতবর্ষের প্রথম মানবতাবাদী দর্শন এবং প্রথম বিদ্রোহ তারা ছিলেন স্পষ্টভাষী, উচ্চকণ্ঠ, সম্পূর্ণরূপে ভাবববদ বর্জিত, তাই তাদেরকে ঊনিশ শতকের ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর পরিণতি বরণ করতে হয়েছে আসলে মানুষ সর্বদা সব দর্শন গ্রহণ করতে প্রস্তত থাকে না, তবে তাদের ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে নেবার প্রয়োজন রয়েছে
শব্দকে চার্বাকগণ প্রমাণ হিসেবে মেনে নেন নি,কারণ শাস্ত্রসমূহে যা লেখা  আছে তার অনেক কিছুই অযৌক্তিক ,দুর্বোধ্য, পরস্পর বিরোধী ,বহু অর্থজ্ঞাপক একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ সকল ধর্মবচন অন্ধের মত মেনে নেয় অথচ প্রাচীন কালে চার্বাকগণ কতটাই না যুক্তিবাদী হয়ে উঠেছিলেন; এমনকি তারা কার্য-কারণ সম্পর্ককেও সন্দেহের উর্ধ্বে রাখেন নি পৃথিবী জীব জগৎ সস্পর্কে 

ধর্মশাস্ত্রগুলোতে গল্পের অভাব নেই, কিন্ত চার্বাকগণ কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে বলেন যে-মাটি, পানি, আগুন, বাযুর সমন্বয়ে জগতের সৃষ্টি জীব জগতের মধ্যে মানুষও অন্তর্ভক্ত! গ্রীক দার্শনিক এমপিডকালিসও চার্বাকগণের মত - মাটি, জল , আগুন বাযুকে মৌলিক উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেন থ্যালিস পানিকে মূল সৃষ্টির উপাদান মনে করেন; এনাক্সিমেনিস বলেন, বায়ু সৃষ্টির মূল উপাদান তিনি আরও বলেন, কিছু উপাদান সর্বদাই বর্তমান ছিল কারণ শূণ্য থেকে কিছুই সৃষ্টি হতে পারে না

আমরা জানি বিবর্তন বিদ্যা আধুনিক ইউরোপের সৃষ্টি চার্বাকগণের বিবর্তন সম্পর্কিত ধারণা ইউরোপীয় ধারণার অগ্রবর্তী  চার্বাক দর্শনের সূত্রগুলোকে সরল বলার সযোগ আছে কিন্তু সব চিন্তাই বিকশিত হয় , চার্বাক চিন্তা বিকশিত হতে পারেনি যদি হত তবে  কার্ল মার্কস- এঙ্গেলস, ডারউইনের-এর মত বস্তুবাদী মনীষী ভারতবর্ষেও জন্ম নিতেন
 তাছাড়া চার্বাকদের মূল কোন গ্রন্থ সংরক্ষণ করা হয়নি সাংখ্য,জৈন, বৌদ্ধ দর্শনও বিবর্তন সমর্থন করে তবে তা সম্পূর্ণ ভাব মুক্ত নয়

বস্তুবাদ যে ভাববাদের পাশাপাশিই সর্বদা বিরাজমান ছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে-কিন্তু তাকে কখনই প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্থানে যেতে দেওয়া হয়নি কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক: ** ভীমকে অজগর- সর্প পেঁচিয়ে ধরেছে-যুধিষ্ঠির তাকে উদ্ধার করতে এলেন, এখানে যুধিষ্ঠির আর সর্পের সংলাপ যথেষ্ট গুরুত্বের দাবী রাখে

সর্প-ব্রাহ্মণ কে?
যু -সত্য, দান, ক্ষমা, সচ্চরিত্র, অহিংসা,তপস্যা, দয়া যার আছে তিনিই ব্রাহ্মণ
সর্প-শূদ্রের মধ্যেও এই সবগুণ থাকতে পারে
যু- যে শূদ্রের মধ্যে ওইসব গুণ রয়েছে তিনি শূদ্র নন তিনি ব্রাহ্মণ
সর্প-জ্ঞাতব্য কি?
যু-সুখ,দুঃখহীন পরমব্রহ্মই( সবিশেষ নয়, নির্বিশেষ ঈশ্বর) জ্ঞাতব্য; যাকে লাভ করলে আর শোক থাকে না
সর্প- এমন কাউকে তো দেখা যায় না যিনি সুখ, দুঃখের উর্ধ্বে
যু- আপনি যাই মনে করুন, সুখ,দুঃখাতীত ব্রহ্ম রয়েছেন
সংলাপটিতে ভাববাদী আর্য আর বস্তবাদী অনার্য চিন্তার সংঘাত সহজে অনুমেয় সর্প মূলত অনার্য কোন জ্ঞানী ব্যক্তি

**১০রামায়ণের  আর একটি উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য; রাম বনবাসে যাবার প্রাক- কালে জাবালি নামক এক জ্ঞানী ঋষি এলেন তাঁকে কিছু বাস্তব বুদ্ধি দেবার জন্যে তিনি বললেন-“দশরথ যেখানে যাবার সেখানে গেছেন, তুমি বৃথা বিনষ্ট হচ্ছ, প্রয়োজনীয় বিষয়ে যারা ধর্মপরায়ন হতে যায় তাদের জন্য আমার দুঃখ হয়, তারা ইহ লোকে কষ্ট পায়, মরণান্তেও বিনাশ পায় পিতৃশ্রাদ্ধে কেবল অন্যের নাশ হয়,মৃতব্যক্তি কখন আহার করতে পারে? চতুর লোকের শাস্ত্রে আছে-যজ্ঞ কর, দান কর,তপস্যা কর ইত্যাদি, এর উদ্দেশ্য কেবল জনসাধারণকে বশীভূত করা অতএব রাম তোমার এই বুদ্ধি হোক যে, পর লোক নেই যা প্রত্যক্ষ তার জন্যই উদযোগী হও যা পরোক্ষ তা পরিত্যাগ কর তুমি সর্ব সম্মত সদ্যুক্তি অনুসারে ভরতের উপর অর্পিত রাজ্য গ্রহণ কর রাম বা অন্য ঋষিগণ জাবালির সাথে একমত হননি বরং তাদের চাপে জাবালি বলতে বাধ্য হন, ‘আমি অবস্থানুসারে কখনো আস্তিক কখনো নাস্তিÍ হই

১২*মহাভারতের হিড়িম্বক, বক,কির্মির, চার্বাক,সর্প ঘটৎকচ এবং রামায়ণের বানর সকল, জটায়ু প্রমূখ ছিলেন মূলত অনার্য জনগোষ্ঠী  আর্য ঋষিগণের শৈল্পিক জ্ঞানের প্রশংসা না করে পারা যায় না! জাবালি অনার্য ব্যক্তি না হলেও লোকায়ত দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন আবার উদ্দালকের চিন্তাও ছিল বস্তু নির্ভর।

তবে আর্য অনার্য দর্শন চিরকাল সংঘাতময় অবস্থায় থাকেনি, কালের প্রবাহে সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়েছে ভগবদগীতাতে সেই সমন্বয় দেখতে পাই গীতাকে মহাভারতের সমকালীন মনে করা হয় না এটিকে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করা হয় গীতাতে এমন কিছু মন্ত্র রয়েছে যা পরবর্তী কালের রচনা *গীতার রচনা কাল ৬০০ খ্রি. পূ. বা তার সামান্য পূর্বাপরের  বলে পণ্ডিগণ মত দেন

গীতার দর্শন অনুসারে ঈশ্বর কোন কাজ করেন না প্রকৃতিই কাজ করে ঈশ্বর হলেন জগতের পিতা আর প্রকৃতি তাদের মাতা অপর একটি মন্ত্রে রয়েছে;
#ভুমি, জল, বায়ু, আকাশ,মন, বুদ্ধি, অহংকার এই আট প্রকার আমার জড় প্রকৃতি
# এই আট প্রকার প্রকৃতির নাম অপরা( জড়,নিকৃষ্ট) প্রকৃতি ইহা ছাড়া আমার আর একটি প্রকৃতি রহিয়াছে, তাহার নাম পরা (চেতন- শ্রেষ্ঠ) প্রকৃতি হে মহাবাহো! জানিবে তাহাই এই সমস্ত জদৎকে ধারণ করিয়া রহিয়াছে এই পরা অপরা প্রকৃতি হইতেই সর্ব প্রাণীর সৃষ্টি হইয়াছে
এখানে ভাব বস্তুবাদী দর্শনের মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি সুস্পষ্টএই দর্শনে জড় চেতনাকে সমান্তরালভাবে দেখানো হয়েছে

চার্বাকের সময় নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে, আবার আদি শাস্ত্র হিসেবে ঋগবেদের বয়স কত তাও সঠিকভাবে জানা যায় না চূড়ান্ত সিদধান্ত নেবার সময় এখনও  আসেনি

রাধাকৃষ্ণনের যুগবিভাগ:
চার্বাক, জৈন, বৌদ্ধমতবাদের উৎপত্তিকাল : ৬০০ খ্রি.পূ
.ভগবদগীতা উপনিষদ : ৫০০ খ্রি.পূ
. ষড় দর্শনের প্রসার : ৩০০খ্রি.পূ--২০০খ্রি.পূ
৪.ঋগবেদের রচনা কাল খ্রি.পূ.১২০০-৬০০অব্দ (ম্যাক্সমুলার)
তিলক ও জ্যাকবির মতে বেদ রচনার কাল-খ্রি.পূ. ৪৫০০-২৫০০ অব্দ
কিন্তু ঋগবেদের কোন কোন সূক্তের রচনাকাল খ্রি.পূ.৬০০০ অব্দ বলে তিলক মনে করেন।

চার্বাক দর্শনকে ঋগবেদের সমকালীন মনে করা হয়, আর ঋগবেদ রচনার সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা যায় নিমনে করা হয়, বেদ রচিত হয়েছে প্রায় ১০০০ বছর ধরে , ১৬* .মু.শহীদুল্লর মতে ভারতীয় হিন্দ- আর্য ভাষার আবির্ভাব ২৫০০খ্রি.পূ আর বৈদিক ভাষা এসেছে (১২০০ খ্রি.পূ) সুনীতিকুমার  চট্টোপাধ্যায় বেদ সংগ্রহের কাল ধরেছেন ১০০০খ্রি. পূ কিন্তু আর্যদের আগমন কাল খ্রি.পূর্ব ১৫০০ অব্দম্যাক্সমুলার বেদের সময় ধরেছেন খ্রি.পূ ১২০০-৬০০খ্রিপূঋগবেদের সবগুলো মন্ত্র কি ওই সময়েই রচিত হয় ? অনেকে তাই মনে করেন, কিন্তু প্রকৃত সত্য ভিন্ন এমনটা নয় যে আর্যগণ ভারতবর্ষে প্রবেশ করে , মন্দির-আশ্রম বানিয়ে অতঃপর আরাম করে মন্ত্র রচনায় মনোযোগ দিয়েছেন এটা মনে করার কারণ আছে যে তারা ভারতবর্ষে প্রবেশের পূর্ব হতেই কিছু কিছু মন্ত্র রচনা করেছিলেন, এবং এগুলো শ্রুতি হিসেবে চলে আসছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রথম পর্যায়ে এর সুর- ছন্দগুলো ছিল এমন যে সে গুলোর লিখিত রূপ দেওয়া ছিল অসম্ভব, পরবর্তীতে সেগুলো লৈখিক রূপ পাবার যোগ্য হয় ১৪*ভারতের কেরালা প্রদেশে অদ্যাবধি প্রাচীন সেই সুরের ফসিল বিদ্যমান রয়েছে, যে গুলোকে স্বরলিপিতে নিয়ে আসা আজও কষ্টকর অদ্যাবধি সেগুলো বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হচ্ছে  

আর্য সংস্কৃতির প্রচীনত্ব ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশের ভাষা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধারণা করা যায এছাড়া প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মিথ দেবদেবী দের মধ্যে সাদৃশ্য তাদের সগোত্রীয় বলে ভাবতে বাধ্য করে  ১৫*যেমন ধরা যাক: ককেশীয়দের পবন দেবতার নাম-মারুত্তস(সংস্কৃত-মরুৎ), সূর্যদেবতার নাম-সূর্য্যস(সংস্কৃত-সূর্য) তুরস্কের একটি সন্ধি পত্রে, -মিত্র, অরুন,বরুন, ইন্দ্র, নাতস্যদ্বয়গণের (অশ্বিনিকুমারদ্বয়) উল্লেখ আছে

চার্বাক দর্শনও কি অতটাই প্রাচীন? এটা মনে করার কারণ নেই যে আর্যগণ বংশ পরম্পরায় একটা নাস্তিক্য মতবাদকে এতদূরে  নিয়ে এসেছেন *অন্তত চার্বাক দর্শনের প্রথম উল্লেখকারী দেবগুরু বৃহস্পতি অতটা প্রাচীন নন এটা আমরা জানি যে অনার্য সংস্কৃতি যথেষ্ট উন্নত ছিল, সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে আর্যগণের আগমনের প্রায় পনেরশত বছর পূর্বে  (২৭০০ খ্রি.পূচার্বাক দর্শন হল সেই সভ্যতা নির্মানকারী অনার্য মনীষীদেরই দান লোকায়ত দর্শনগুলো কালের সীমা অতিক্রম করে চার্বাকের মধ্যে স্ফটিকাকার লাভ করেছে পরবর্তীতে ভাববাদের ভাব আমাদের এমন ভাবে ভাসিয়ে নিয়ে গেল যে , আঁকড়ে ধরার মত কোন বস্তুই আমাদের হাতে রইল না আশান্বিত হয়ে উঠি এটা দেখে যে, এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলশ্রুতিতে বৃক্ষ তলদেশে কিছুটা আলো প্রবেশ করছে

তথ্যসূত্র :
.        ভারতীয় দর্শন : এস. রাধাকৃষ্ণন
.         ভাতীয় দর্শনরমেন্দ্রনাথ
.        ভারতীয় দর্শন : প্রমোদ বন্ধু সেনগুপ্ত
.        বাঙ্গালীর ইতিহাস : নীহাররঞ্জন রায়, দ্বাদশ অধ্যায়
.        সিদ্ধার্থ : হেরমান হেস
.       ঋগবেদ : ১০ -,৭২সুক্ত, ঋগ
.         ভগবদ গীতা ; / ,,১৬/,
.       সোফির জগৎ : জোসটিন গার্ডার
.        মহাভারত : বনপর্ব, শান্তি পর্ব
১০.      রামায়ণ : অযোধ্যাকাণ্ড
১১.      সর্বদর্শন সংগ্রহ : মাধবাচার্য
১২.      ইতিহাসের আলোকে রামায়ণ : সুধাময়দাস, পৃ-৪৮, ৪৯, ৭৮
১৩.     ইতিহাসের আলোকে মহাভারত : সুধাময়দাস : পৃ-৮০
১৪.      হিস্ট্রি আব ইণ্ডিয়া; বি বি সি ডকুমেন্টরী
১৫.      বাঙ্গালির ইতিহাস : রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
১৬.     বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত : . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, উপক্রমণিকা, পরিশিষ্ট
১৭.      চার্বাকের উল্লেখ আছে -মৈত্রায়নী উপনিষদ, বিষ্ণপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বৃহদারণ্যক উপনিষদ,ছান্দগ্য উপনিষদ, কথা উপনিষদ, পতঞ্জলির ভাষ্য, বিদ্যাবদান বৌদ্ধ শাস্ত্র ইত্যাদি
১৮.দর্শন-দিগর্শন (১ম পর্ব)-রাহুল সাংকৃত্যায়ন
১৯.প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস (১ম খণ্ড,প্রথম ভাগ)-ভারত সরকারের শিক্ষাধিকারিক বিভাগ
২০.পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস-বার্ট্রাণ্ড রাসেল

দ্র: চার্বাক দর্শন সম্পর্কে অনেকে জানতে চেয়েছেন তাই প্রবন্ধটি পুনরায় প্রকাশ করা হল।


আরো পড়ুন--