শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১৮

কবি হুমায়ুন আজাদ: বিষয় ও শিল্প প্রবণতা

                          কবি হুমায়ুন আজাদ: বিষয় ও শিল্প প্রবণতা
 এক.
ত্রিশের কাব্যের বিষয় বৈচিত্র ও আঙ্গিকের নতুনত্ব কবি হুমায়ুন আজাদকে স্পর্শ করেছিল কিন্তু প্রভাবিত করেনি। পঞ্চপা-বের বিদ্রোহ ও নতুনত্বকে তিনি অঙ্গীভূত করেছেন কিন্তু তাঁদের শিল্পের অমানবিকীকরণ, বহিরিস্থতা, হতাশা-বিষণ্নতা, বিচ্ছিন্নতা, অপ্রকৃতস্থতাকে গ্রহণ করেননি। ‘কল্লোল’ ছিল তাঁর পক্ষপাতের ক্ষেত্র, বুদ্ধদেব বসুর প্রভাবকে তিনি উপলব্ধি করেছেন আবার রবীন্দ্রনাথের জীবনদৃষ্টিকেও উপেক্ষা করেননি। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন গ্রহণ করেছিলেন মিল, কোঁৎ, বেন্থামের চিন্তাকে মধুসূদন গ্রহণ করেছিলেন হোমার, মিল্টনকে।  হুমায়ুন আজাদ গ্রহণ করেছিলেন সম্পূর্ণ ইউরোপকে। তিনি ফ্রয়েড,মার্কসীয় চিন্তার পাশাপাশি  ইউরোপের নারীবাদি চিন্তা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কবিতার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে  মালার্মে, হাইনে, এজরা পাউন্ড, ডিলান টমাস, ই ই কামিংস, ডব্লিই. বি. ইয়েটস, বোদলেয়ার আমেরিকার হুইটম্যান এবং ইউরোপের অন্যান্য রোমান্টিক কবিদের রচনাবলীও তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। অনুবাদ করেছেন  জন কীট্স, ম্যাথিউ আরনল্ড,ডব্লিউ বি ইয়েট্স্, ই ই কামিংস, হাইনরিশ হাইনে প্রমুখের স্বল্প কিছু কবিতা।
 হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ‘খাপ না খাওয়া মানুষ’, সংঘ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা গুরুবাদে ছিল তাঁর অতীব অনীহা। তাঁর মতে এসব নিম্ন মাঝারিদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া। প্রতিভাবানদের প্রয়োজন হয় না কোন সংঘের তাই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন দেবস্তুতি ও মহাপুরুষবন্দনা। তিনি মনে করেন দুরাচারীরাই আজ বেশি সংঘবদ্ধ। তিনি হয়ে উঠেছেন একাকী-নিঃসঙ্গ। ‘খাপ-না-খাওয়া মানুষ, ‘নিঃসঙ্গ ছিলাম’ প্রভৃতি কবিতায় তিনি নিজের নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের কথা বলেছেন, এটি কেবল তাঁর কাব্যিক ভাবাবেগ নয়, এটি তাঁর ব্যক্তিস্বভাব সম্পর্কে স্বীকারোক্তিও।
 ভাব-ভাষায় তিনি ত্রিশের নিকটবর্তী হলেও চেতনা ও বিষয়বস্তুতে হুমায়ুন আজাদ স্বতন্ত্র। ষাট ও সত্তরের দশকের বিনির্মাণের রক্তাত্ব সংগ্রাম ও আশির দশকের স্বপ্নভঙ্গের সময়ে হুমায়ুন আজাদ ব্যর্থতা ও বিষণ্নতার গান গাইতে বাধ্য হলেও তাঁর বিদ্রোহের রূপ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ; দুর্বৃত্তায়ন ও নির্বুদ্ধিতাকে তিনি অসঙ্কোচ চিত্তে ঘৃণা  করেছেন। তাঁর কবিমানস সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও ভিন্ন ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষরপরিবাহী; তাঁর নেই জীবনানন্দের আত্মনিমগ্নতা, রবীন্দ্রনাথের বহিরিস্থতা, কল্লোলের হতাশা, জীবন বিতৃষ্ণা, নেই বুদ্ধদেব বসুর-বোদলেয়ারের হতাশাক্লিষ্ট ক্লেদাক্ততায় নিমগ্নতার প্রয়াস। দেশ-কাল চেতনা, বস্তুবাদী দর্শন, প্রথা বিরোধিতা, প্রকৃতি, প্রেম নিভৃত চিন্তা সবই ‘হুমায়ুন আজাদী’ ব্যক্তি স্বাতন্ত্রে ভিন্নমাত্রা লাভ করেছে। দার্শনিকের নিমগ্নতা, জ্ঞানীর গাম্ভীর্যের সঙ্গে ব্যক্তিত্ব ও রসবোধে হুমায়ুন আজাদ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। হুমায়ুন আজাদ ‘প্রথা বিরোধী’ কবি, তাঁর প্রথা বিরোধীতা অকৃত্রিম, কোন কোন ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত। ‘তিনি নানান প্রবচন ব্যবহারের মাধ্যমে কবিতায় বাণীস্বত্ব সংযোজনের প্রয়াস পেয়েছেন  যে কারণে তাঁর কবিতা সমাজ ও জাতির সংকটকালে উচ্চারিত হয়েছে মানুষের মুখে মুখে।’ ১ মামুনুর রহমান, বাংলা কবিতা  তিনি ছিলেন প্রথা বিরোধী, তাঁর এই প্রথা বিরোধীতাকে অনেক সময় উন্নাসীকতা বলেই মনে হয় কিন্তু তিনি বিশ্বাসী ছিলেন গণতন্ত্রে, অপগণতন্ত্রে তাঁর বিশ^াস ছিল না, আস্থা নেই এক দল বা স্বৈরতন্ত্রে। তাঁর আস্থা নেই পৌরাণিক স্বর্গে, মানুষকে পরিশ্রম করে আধুনিক চিন্তা দিয়ে ভবিষ্যত নির্মাণ করতে হবে, পশ্চাতে প্রত্যাবর্তনের প্রচেষ্ট সেটা প্রতিক্রিয়াশীলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘প্রাচ্যকে আমি হাজার হাজার বছর ধরে প্রথার পায়ে অবনমিত দেখেছি এবং অনেকাংশে প্রত্যাখান করেছি। আমি যদি উনিশ শতকে জন্ম নিতাম, তাহলে ওই প্রত্যাখান হতো অত্যন্ত স্পষ্ট।’ ২ আমার নতুন জন্ম, হুমায়ুন আজাদ, পৃ. ৬৪
‘ মূল্যজ্ঞানের চেতনায় একটি আদর্শকে তিনি কবিতায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সেখানে স্মৃতিজড়িত গ্রাম-নিসর্গই মূলধারা-বস্তুত সেখানেই তাঁর সর্বোত্তম প্রতিষ্ঠা।..চিত্ররূপময়তায় আবাহনে বাংলাদেশের ঋতু-রঙ নগর-গ্রাম নির্বিশেষে বর্ণিল। বাক্সময় স্বদেশ তবে বিপরীতপ্রান্তে আবার দুঃখদীর্ণ বিনষ্ট স্বদেশের প্রতিও ক্রুদ্ধতা বিরাজমান। হুমায়ুনের আবেগ শুধু রোমান্টিক শর্তে পরি¯্রুত নয়, আনন্দ-আলিঙ্গনের ভেতর দিয়ে এক ধরণের যৌক্তিক শাসন পেয়েছে। কারুচেতনায় তা বিভাঋদ্ধ। জীবদ্দশায় হুমায়ুন আজাদ কবিমনে উন্নত অন্তর্লীন মুগ্ধতায় প্রকৃতিবিশ^কে ধারণ করলেও বিভিন্ন কাব্যে কখনো অতিশয় অতীত মুগ্ধতার পুনরাবৃত্তি (রাঢ়িখাল বা বেড়ে ওঠা স্মৃতিময় গ্রাম), কখনোবা প্রথার-অর্গল ভাঙার বেপরোয়া তৎপরতায় কবিচিন্তন বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তবে বাকপ্রতিমা-নির্মাণ, শব্দের কাব্যময় কল্পনাবিন্যাস আমাদের কবিতায় নতুন ধর্ম অর্জন করেছে।’ ৩ বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস, শহীদ ইকবাল, পৃ.২০২-২০৩
হুমায়ুন আজাদের শিল্পী মানস পরিস্ফূট হয়েছে তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। বাংলার রূপে মুগ্ধ তিনিও, কিন্তু  সময় তাঁকে সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তিনি জন্মেছেন অন্যদের সময়ে, যে সময় কেড়ে নিয়েছে তাঁর সোনালি শৈশব, নষ্ট করেছে যৌবনের উচ্ছলতা, কলুষিত করেছে বার্ধ্যক্যের জ্ঞাননিবিষ্টতার সুখ। ফুল আর পাখিরা হত তাঁর কবিতার বিষয়, বেলা কাটত প্রকৃতির লীলা দর্শন করে বা সৃষ্টির মাঝে আত্মনিমগ্নতায় নিবিষ্ট থেকে কিন্তু ‘বেহাত’ বিপ্লব তাঁকে করেছে প্রথাবিরোধী-বিদ্রোহী হুমায়ুন আজাদ। তাঁর কাব্যের একটি বৃহদাংশে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশের জন্যে উচ্চকিত শোক আর বিদ্রোহের বাণী শোনা যায়। অস্থির সময় তাঁকে জীবন ও প্রকৃতিতে নিমগ্ন হতে দেয়নি-ব্যর্থতার নিঃসঙ্গতাই তাঁর কাব্যগতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তথাপি তিনি প্রকৃতি ও জীবনকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি, কিন্তু প্রকৃতি-প্রেম –জীবনভাবনা ঘনীভূত হয়ে ওঠার অবকাশ পায়নি। ’৪৭ পরবর্তীতে  বাঙালির পরিচয় রক্ষার দীর্ঘ সংগ্রাম এবং ’৭১ এর যুদ্ধোত্তর কালের গণতান্ত্রহীন শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের অনির্ধারিত জনবিক্ষোভ কবিচিত্তকে অস্থির করেছে।   তিনি বিরোধীতা করেছেন কিন্তু বিপ্লবের আহ্বান করেননি, কেননা তিনি আজীবন কেবল ভাঙতেই দেখেছেন, নিকটকালে তিনি বাঙালির সমাজ-মানসে কোন পরিবর্তন দেখতে পাননি। তাই তাঁর কবিতা কোন মতবাদের ভিত্তিতে স্থিত নয়, দুর্বৃত্ত ধনবাদীদের বিপরীতে বামেরা বিলুপ্ত ডায়নোসর। ৪নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ, অনুপ সাদি, পৃ. ১০৬ একারণে তিনি নন সমাজতন্ত্রের কবি বা বিপ্লবের কবি। সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেনের থেকে এখানেই তিনি ব্যতিক্রম ও স্বতন্ত্র। তাঁরা নির্মাণের আহ্বান করেছেন হুমায়ুন আজাদ এর ভিত্তি গড়েছেন, মুক্তির পথ তাঁর অজানা কিন্তু তিনি জানেন কোন অন্ধকারই চিরজীবী নয়। সমাজতান্ত্রিক বিশে^র বারবার ব্যর্থতা ও ভারতীয় উপমহাদেশসহ বাংলাদেশে বাম রাজনীতির উপর্যুপরি ব্যর্থতা তাঁকে সন্দিহান করেছে তাই তিনি হয়ে ওঠেন নি কোন মতবাদের কবি । তাঁর বিদ্রোহের স্বরূপকে অনেক তরুণ কবিই গ্রহণ করেছেন কিন্তু তার তীব্রতাকে কেউ গ্রহণ করতে পারে নি।
হুমায়ুন আজাদ ‘কাব্য সমগ্র’-এর ভূমিকাংশে লিখেছেন, ‘ খ্যাতি, সমাজ বদল, এবং এমন আরো বহু মহৎ উদ্দেশ্যে কবিতা আমি লিখি নি ব’লেই মনে হয়; লিখেছি সৌন্দর্যসৃষ্টির জন্যে, আমার ভেতরের চোখ যে- শোভা দেখে, তা আঁকার জন্যে; আমার মন যেভাবে কেঁপে ওঠে, সে কম্পন ধ’রে রাখার জন্যে। মানুষের অনন্ত সৃষ্টিশীলতা আমার ভেতর দিয়েও প্রকাশ পাক কিছুটা, এমন একটা ব্যাপারও হয়তো আছে।’ জনপ্রিয়তার অভিলাসে তিনি লেখেননি কিন্তু সময় যেমন দুর্বৃত্তদের জন্ম দিয়েছে তেমনি নির্মাণ করেছে ‘হুমায়ুন আজাদ’।
 তিনি বলেন, ‘ কমিয়েছি উচ্ছ্বাস, অতিশয়োক্তি, ছেঁটে দিয়েছি নিরর্থ বিশ্লেষণ, শব্দ ও বাক্যাংশ, দমিয়েছি যতিচিহ্নের নির্বিচরিতা।’ এর সঙ্গে তিনি বর্জন করেছেন তথাকথিত বাঙালির আবেগ, ব্যর্থ প্রলাপ, ভাবোচ্ছ্বাস। কৃত্রিম আঙ্গিক বিনির্মাণের প্রচেষ্টাও হুমায়ুন আজাদে দৃষ্টিগোচর হয় না। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে আঙ্গিক নির্মাণের প্রচেষ্টা দেখা গেলেও তিনি পরবর্তী কাব্যগ্রন্থসমূহে তাঁর সহজাত শিল্পোচেতনা দ্বারা নবসৃষ্টির প্রয়াসে নিবিষ্ট হয়েছেন। ষাট, সত্তরের দশকের পরাবাস্তবতা, পোস্টমডার্নিজম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, ত্রিশের আধুনিকতা, দুর্বোধ্যতা, অতিপরিমার্জন, প্রথাগত টাইপ কাব্যবিন্যাস এমনকি নারীবাদী চেতনাও তাঁর কাব্যক্ষেত্রে তাঁর স্বীয় ব্যক্তিত্বকে অতিক্রম করেনি। তিনি সর্বাংশে আধুনিক, গ্রাম বা নগরের প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা নেই-তাঁর সম্পূর্ণ দুর্বলতা জীবনকে ঘিরে, জীবনকেই তিনি এঁকেছেন কবিতার আকারে।
হুমায়ুন আজাদ যেমন ক্লিষ্ট হয়েছিলেন তাঁর সময়ের দ্বারা তেমনি তাঁর কবিতা একাদিক্রমে পাঠ করে পাঠকও কোন কোন সময়ে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-বিষণ্নতা বোধে আক্রান্ত হন কেননা তাঁর কাব্য একটা অস্থির সময়েরই প্রতিচ্ছবি। রবীন্দ্রনাথ পাঠ করে পাঠক সুস্থির হন, জীবনানন্দ পাঠ করে আত্মচেতনায় নিমগ্ন হন, নজরুল-সুকান্ত করে বিদ্রোহ ও বিপ্লবে উজ্জীবিত কিন্তু হুমায়ুন আজাদের কাব্য পাঠককে কোন নির্ধারিত গন্তব্যে উপনীত করে না। কোন নির্ধারিত তত্ত্ব, চিন্তা, জীবনবোধ বা দর্শনকে ঘিরে তাঁর কাব্য পরিম-ল আবর্তিত হয় না; তাঁর অনেক ভাব ও ভাবনাই ক্ষণকালীন চেতনা ও স্বতঃস্ফূর্ত। প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থে তাঁর কবিসত্তাই প্রধান হয়ে উঠেছে, এখানে তাঁর বক্তব্য কবিভাষাকে অতিক্রম করতে পারেনি; এরই মধ্যে কোন কোন কাব্যে প্রধান হয়ে ওঠেছে কবির দার্শনিক সত্তা। ‘ টি এস এলিয়ট এবং তাঁর অনুগামীরা ভাষা প্রয়োগের দিক দিয়ে চরমপন্থী বলে আখ্যায়িত হতে পারেন। তাঁদের বক্তব্য এই যে, কবিতার পুরো অর্থটা নাই-বা জাহির হলো, তাতে এসে যায় না কিছুই। কাব্যের আস্বাদ নিতে হবে শব্দ ও পঙক্তিগুলোকে নিংড়ে। বারবার পড়ে যেতে হবে; ছন্দোবদ্ধ শব্দ আর পদ মনের মধ্যে কোমল কঠোরে বাজতে থাকবে, অনুরণিত প্রতিধ্বনি হতে থাকবে; কবির বক্তব্য যতটুকু ধরা দেয় তা-ই সই।’  ৫ কবিতা ভাষা মাতৃভাষা, রণেশ দাশগুপ্ত প্রাচীন গ্রীক ঐতিহ্যপ্রিয় এলিয়ট বা আধুনিকতার কবি জীবনানন্দ দাশ শিল্প প্রেরণা হয়েছেন কোন কোন সময়। আবার অপরপক্ষে তাঁর কতিপয় কবিতা শব্দ আর বাক্যের কারুকাজের বদলে বক্তব্যের অনুশাসনই প্রধান হয়ে ওঠে এক্ষেত্রে আব্দুল গনি হাজারীর ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ এবং শামসুর রাহমানের ‘যদি তুমি আসো’ প্রভৃতি কবিতাকে অনেকে প্রেক্ষিত রূপে চিহ্নিত করতে চান।
‘অলোকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩)-এ তিনি  কবিভাবনা সুনির্দিষ্ট, সুচিন্তিত, বিষয় ও আঙ্গিক সচেতন। এখানে তাঁর স্বকীয়তা স্পষ্ট কিন্তু প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নন। ত্রিশের পঞ্চপা-বের বিদ্রোহ ও খ্যাতি তাঁর স্মৃতিকে উদ্দীপ্ত করে রেখেছে, ইউরোপীয় কবিদের আধুনিক আঙ্গিক ও নারীবাদী চেতনা এবং বাংলা কবিতাকে আর একটি ভিন্নমাত্রা প্রদানের প্রচেষ্টা তৎকালীন কবিদের ব্যতিব্যস্ত করেছিল, তিনিও এর থেকে মুক্ত নন। আঁটোসাটো গঠন, সুনিয়ন্ত্রিত ছন্দ, সংযত ও পরিমিত আবেগ, অর্থের অস্পষ্টতা ও দ্বৈধতা, শব্দের কারুকাজ, যতিচিহ্নের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রভৃতিতে তিনি শ্রমনিবিষ্ট ও সতর্ক। প্রথমকাব্যে তাঁর বিদ্রোহের কণ্ঠ উচ্চকিত নয়, এখানে বিরোধীতা নয় বাস্তবতা বর্ণনায় কবিকে সচেষ্ট দেখা যায়, স্বপ্নভঙ্গ ও শাসকদের বিশ্বাসহন্তা রূপ তখনো স্পষ্ট নয় তাই এখানে প্রথাবিরোধী হুমায়ুন আজাদ স্বরূপে আবির্ভুত নন, তাঁর বিদ্রোহের রূপও এখনো স্পষ্ট নয়। দেশ স্বাধীন হবার অনতিকাল পরেই এই কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু এতে নেই স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস, মুক্তির আনন্দ বা জীবনকে বাংলার কোমল আলো-বাতাসে গড়ে তুলবার স্বপ্ন বরং প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তিনি সংশয় প্রকাশ করেন,
‘আমার বাবার
স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়েছিল আমার জীবনে।
আমার স্বাধীনতা কী রকম হবে আমার সন্তানের জীবনে?
নাকি তাকেও বলতে হবে আমার মতোই কোনদিন,
‘এতো দিনে স্বাধীন হলাম।’
                          হুমায়ুন আজাদ, অলৌকিক ইস্টিমার

পূর্ববর্তী সময়ের অনেক কবিতাই এখানে স্থান পেয়েছে, ষাট বা সত্তরের দশকের সমাজচিত্র অঙ্কন, আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বাস্তবতার বিমর্ষ বর্ণনাই এ কাব্যগ্রন্থের পরিচয় নির্ধারক বৈশিষ্ট্য। হুমায়ুন আজাদের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘জ¦লো চিতাবাঘ’ (১৯৮০)। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থেই কবি হুমায়ুন আজাদ স্বমূর্তিতে আবির্ভুত হয়েছেন, এটা ছিল তাঁর চেতনা ও স্বাতন্ত্রের একটি নির্ধারক উলম্ফন। তাঁর সুপ্ত ভিন্নমাত্রার ব্যক্তিত্ব এখানে বিষয় ও আঙ্গিকে প্রভাবক রূপে স্বাতন্ত্রের রূপকে উদ্ভাসিত করেছে। এই স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা তাঁর পরবর্তী চারটি কাব্যগ্রন্থে অব্যাহত দেখা যায়। আড়ষ্টতা ও সংকোচকে অপসারণ করে পরবর্তী কাব্যগ্রন্থসমূহে তিনি আরও বেশি স্পষ্ট ও সুনিশ্চিত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কবিরা সমস্বরে জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন সৃষ্টির। সত্তরের দশকে ও যুদ্ধোত্তর পর্বে দেশীয় মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের বিশ্বাস ভঙ্গের দিনে কবিদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর চিৎকার ও কোলাহলে পরিণত হয়। কেউ কেউ চিন্তা ও রাজনৈতিক চেতনাকে অপসারিত করে শিল্পের কারুকার্যে আত্মনিমগ্ন হন। কবি হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রতিবাদের ভাষাকে কখনই কোমল করেননি বরং দিনে দিনে তা আরও শাণিত হয়েছেন। হুমায়ুন আজাদের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থসমূহ হল:  সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫), যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল (১৯৮৭), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮), পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪)।

‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ হুমায়ুন আজাদের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা এবং এটাই হয়তো তাঁর শেষ বাণী, শেষ উক্তি বা কবি মানসের অন্তিম পরিণতি। জীবনানন্দকে যেমন পাওয়া যায় ‘বোধ’ কবিতায় তেমনি  যুগযন্ত্রণা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, কবিস্বভাব, দেশপ্রেম প্রভৃতি কবিবৈশিষ্ট্যসহ হুমায়ুন আজাদ যেন এই কবিতায় প্রবিষ্ট হয়ে রয়েছেন।  কাব্য পাঠে কবির প্রতি পাঠক যেমন একাত্ম হন তাঁর জীবন বোধের সঙ্গে তেমনি বেদনাও অনুভব করেন কবিজীবনের ব্যর্থতাবোধ থেকে উদ্ভূত চাঞ্চল্য দ্বারা। প্রিয় বাংলার রূপে তিনি মুগ্ধ, আলো-আঁধারের খেলা তাঁর হৃদয়কেও আবিষ্ট করে কিন্তু তিনি বিস্মৃত হতে পারেন না যে, বাংলার ফুল পাখিরাও দুর্বৃত্তায়নের কবল থেকে মুক্ত নয়।
‘আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ তখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
আমি ভুল নদীতে ¯্রােত হয়ে বয়েছিলাম। আমার নদী তখনো উৎপন্ন হয়নি।
---
আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে
আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।
--
আমার সব কিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।
--
আমি যে-পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম
             অন্যদের সময়ে।’ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে

‘অলৌকিক ইস্টিমার’-এ কবি তখনো সন্দিহান, তিনি ভাবতে চান না বাঙালি আর একবার বিভ্রান্ত হবে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে মুক্ত নয় দেশের একটি মানুষও। অতীতের বেদনাদায়ক স্মৃতি, অনিশ্চিত ভবিষ্যত, উপায়হীন, লক্ষ্যহীন জনজীবন - যেন এক অন্ধকার চক্রব্যুহ যেখান থেকে বেরুনোর কোন পথ নেই, নেই আলোর সম্ভাবনা। পরাবাস্তব কাব্যের  মতোই বাংলার জনজীবন দুর্বোধ্য আর অমীমাংসার বিবরে নিমজ্জিত। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে তাঁর গোধুলির স্বল্পআলো জমাট অন্ধকারে পরিণত হল।

‘হুমায়ুন আজাদ, হতাশ ব্যর্থ শ্রান্ত অন্ধকারমুখি;
উৎফুল্ল হয় না কিছুতে-প্রেমে, পুষ্পে, সঙ্গমেও সুখী
হয় না কখনো; আপন রক্তের গন্ধে অসুস্থ, তন্দ্রায়
ধ্বংসের চলচ্চিত্র দেখে, ঘ্রাণ শুঁকে সময় কাটায়;
 ওকে বাদ দেয়া হোক, নষ্ট বদমাশ হতাশাসংবাদী।’
-এ-আঁধারে উন্মাদ ও অন্ধরাই শুধু আশাবাদী।
                                        উন্মাদ ও অন্ধরা, জ্বলো চিতাবাঘ
কবির এই ব্যর্থতাবোধ উত্তোরোত্তর কেবল বৃদ্ধিই পেয়েছে, তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ পেরোনোর কিছু নেই’। একের পর এক পাহাড় আর সমুদ্র অতিক্রম করে করে কবি ক্লান্ত, ক্লান্ত দরিদ্র বাঙালিরাও; সব পেরিয়ে এসে, জীবনের শেষ সীমায় কবি দেখছেন পেরিয়ে যাবার আর কিছুই নেই-সম্মুখে যে অন্ধকার এর পরেও নেই কোন সৌরকিরণ। শিশিরের শব্দে এখানে সন্ধ্যা নামে না, এখানে যে সন্ধ্যা নামে তার রূপ ভৌতিক, গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী। বির্যস্ত, ক্লান্ত, বিগতযৌবন কবি বাংলাদেশের নামও আর উচ্চারণ করতে চান না, সে নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য স্বপ্ন-স্বপ্নেরা সেখানে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। সেখানে পাখা ঝাপেেট পঙ্কে ডুবে যায় স্বপ্নের রাজহাঁস।

‘যখন আমরা বসি মুখোমুখি,--
তখন ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস কোরো না;
আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।
--
তার ধানখেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমণীয় ,গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী,
কিন্তু প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেয়ো না;
আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।’
                                            বাঙলাদেশের কথা, পেরোনোর কিছু নেই

হুমায়ুন আজাদ মৃত্যু চেতনায় আচ্ছন্ন নন মৃত্যুভাবনা তাঁর কবিতায় দুর্লভ কিন্তু মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন অগণিত দেশপ্রেমিক যোদ্ধা, কবি, দার্শনিক, নারী-শিশু এবং জনতার মত । হুমায়ুন আজাদ এমন একটি দেশ আকাক্সক্ষা করেছেন যেখানে ফুলেরা নির্ভয়ে প্রস্ফুটিত হবে, মাছেরা নিশঙ্কচিত্তে খেলা করবে, পানকৌড়িরা বিলে-ঝিলে আহরণ করবে জীবীকা আর বকেরা সরোবরে নিবিষ্ট হবে জীবন ভাবনায়। যেখানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণিরা  নিশ্চিত জীবনের স্বাদ পায় যে স্থান সর্বদা সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত থাকে। এরূপ একটি পৃথিবীর জন্যেই হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুবরণ করবেন বলে আশঙ্কা করেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা সত্য হয়েছে, ‘ছোট্ট ঘাসফুল, একটি টলোমলো শিশিরবিন্দু, এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্যেই তিনি প্রাণ দিয়েছেন।

‘আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্যে
একটিফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।’
                               আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে, কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু

দুই.
হুমায়ুন আজাদের কাব্যের বিষয়বস্তু বহুবিস্তৃত, দেশ-কাল, প্রেম ও নারী, প্রকৃতি, নিভৃত চিন্তা, আত্মভাবনা প্রভৃতি বিষয়কে ঘিরে তাঁর কাব্য প্রবণতা গতিলাভ করেছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থে রয়েছে স্বল্প পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়াস; ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ সম্পর্কে কবি হুমায়ুন আজাদ বলেন, ‘অলৌকিক ইস্টিমার নামে একটি কবিতা লিখেছিলাম; লিখেছিলাম কেননা বাল্যকালের পদ্মার ইস্টিমারের বাঁশির শব্দ, তার দূর থেকে দেখা রূপ মনে হতো যেনো মহাজগতের অপর পার থেকে ভেসে আসছে এক অলৌকিক ইস্টিমার-আমার ভেতরে চিরকালের জন্য গতিশীল হয়ে আছে। আমার মনের পদ্মায় চিরকাল ধ’রেই এক আশ্চর্য ইস্টিমার চলছে।’ ৬ বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস, শহীদ ইকবাল, পৃ.২০১ এই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে ভূমিকাংশে কবি  বলেছেন, ‘ আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক ইস্টিমার, যার জন্যে আমার বেশ মায়া; ওটিতে বেঁচে আছে আমার কাতর সুখী অসুখী প্রথম যৌবন।’

দেশ –কাল
’৭৩ সালে প্রকাশিত ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ কাব্যে কবি দেশের উন্নতি ও স্থিরতার বিষয়ে সন্ধিহান হলেও জাতির চিত্তোন্নতির সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করেননি। অন্ধকার যাত্রার কালেও আলোর ক্ষীণ স্রোত বহমান থাকে। ‘বঙ্গ উন্নয়ন ট্রাস্ট’ কবিতায় তিনি বলে, মার্কিন, রুশ, চিনা এরা কেউই সুইচ টিপে বাংলার উন্নয়নকে ব্যহত করে না; অবিবেচনা প্রসূত কর্ম থেকে উদ্ভূত কর্মফলের দায় সর্বাগ্রে আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত হই। বাংলার মাটি হয়ে উঠেছে ‘ব্লাড ব্যাংক’, বাংলার সব রক্ত তীব্রভাবে মাটি অভিমুখী। নির্মম বাস্তবতা কবিকে আশাবাদী করে না। ‘সব সাংবাদিক জানেন’ কবিতায় কবি আশঙ্কা ব্যক্ত করেন- ‘এদেশ নিউজপ্রিণ্টের মতো বিবর্ণ ধূসর হয়ে যাবে’- এই আশঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারে না কেউ।
‘তারপর দেখেছি আমি নিজে
জলে বা শিশিরে নয় সারা বাঙলা রক্তে গেছে ভিজে। যে - নদীতে ভাসতো রাজহাঁস
সেখানে ভাসছে শুধু নিরীহ বাঙালির লাশ।’
            খোকনের সানগ্লাস, অ. ই
এই অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কবি তাই প্রত্যাশা করেন এবার ঘর বাঁধার সময়, ঝড়-ঝঞ্ঝার পরে পাখিরা নীড় বাঁধার কর্মে ব্যস্ত হয় বাংলার জনমানুষও স্বপ্ন দেখে-
‘অগ্নির বিকল্প ঘর: বাঙলাদেশে উঠুক শ্লোগান
১৯৭২ বাঙলাদেশে প্রেম আর গৃহের বৎসর।’
                                গৃহনির্মাণ, অ. ই
 আমার ছাত্র ও তার প্রেমিকার জন্যে এলিজি, খোকনের সানগ্লাস, হরোস্কোপ, হুমায়ুন আজাদ, ব্লাড ব্যাংক কবিতায় কবি যুদ্ধের বিভীষিকাকে সংযত আবেগে স্মরণ করেছেন, দেখেছেন বারবার ভেঙে যাওয়া তবুও আশারা বেঁচে থাকে ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ আসা যাওয়া করে তখনো –পূর্ণবেগে, ভরা¯্রােতে, এর যাত্রীরা তাঁর আপনজন।
‘অলৌৗকিক ইস্টিমার আসে সব রাতে
সব বৃষ্টি ভর ক’রে
নদী জ্যোৎস্না ফুলদানি বেয়ে
যারা এসে নামছে জেটিতে তারা আমার গভীর আত্মীয়’
                                             অ.ই

এই আশাবাদও আর অবশিষ্ট থাকে না,পূর্বের সংশয় আর নেই বরং অন্ধকারের গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে দেশ, পরাবাস্তব শিল্পের মতই বাংলা হয়ে উঠেছে অনির্দেশিত, অনিশ্চিত, আর্থ-রাজনৈতিক জটিলতায় বদ্ধ। অতীতের মূল্যায়নে নিবিষ্ট হচ্ছে কেউ কেউ। নির্মম বাস্তবতা থেকে কবি মুখ ফিরিয়ে নিতে চান কাব্যরোমান্টিকতার জগতে, নিবিষ্ট হতে চান কাব্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ছন্দ-অলংকার আর আত্মমগ্নতার অন্তরালে।
‘এজনেই কি আমি অনেক শতাব্দী ধ’রে স্বপ্নবস্তুর
ভেতর দিয়ে ছুটে - ছুটে পাঁচশো দেয়াল-জ্যোৎস্না-রাত্রি-
ঝরাপাতা নিমেষে পেরিয়ে বলেছি, ‘রূপসী, তুমি,
আমাকে করো তোমার হাতের গোলাপ।’
                                 পরাবাস্তব বাঙলা, জ্ব.চি.বা
স্বাধীনতার পূর্বকাল থেকেই দেশের  সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতি দু ধারায় বিভক্ত, অতীতের কথিত সোনালি সময়ে ফিরে যেতে চান কেউ কেউ কিন্তু হুমায়ুন আজাদ অতীতের পৌরাণিক সুখে বিশ্বাসী নন; পুঞ্জিভূত আর্ত, শূন্য, মুমূর্ষু চিৎকারই অতীতের প্রধান স্বর, ভবিষ্যত যদিও অনিশ্চিত তবু তাকে বাঁধা যায় স্বপ্নের অনুশাসনে। দোলাচল ও অরাজকতার একালে ক্ষয়িষ্ণু আশা পরিণত হয় পূর্ণ হতাশায়, মনে হয়, ‘উন্মাদ ও অন্ধরা’ই কেবল আশাবাদী।

‘ফিরবো পেছনে? সম্মুখে তবু তো দোলে ভাঙা দিগ¦লয়, বিভগ্ন সূর্যাস্ত,
অসহায় পাখির পালক, স্বর্ণকঙ্কালের নাচ, যোনি-ও জরায়ু-হীন
Ÿুধার ভেনাস, দুঃস্বপ্ন-ধাতব শুষ্ক গাছপালা, সান্ত্রী-পরিখা আর
ভয়াবহ দুর্ভেদ্য প্রাচীর; পেছনে একার্ধিপত্য করে শূণ্যতা,
আর তার স্তরেস্তরে পঞ্জিভূত আর্ত, শূন্য, মুমূর্ষ চিৎকার।’
                                                   ভূতভবিষ্যৎ, জ¦.চি.বা
নির্মাণের কালে জনজীবন হয়ে ওঠে বিপর্যস্ত, ক্ষমতা দখলের লড়াই আর নানা বিপরীত মুখি চেতনার সংঘাতে অসহায় হয়ে ওঠে মানুষ। সৃষ্টির বদলে আবার সকলে যেন ভেঙে ফেলার দৌরাত্ম্যে তৎপর হয়ে ওঠে। যে বাংলা ভাষা ছিল একদা বিদেশি শৃঙ্খলে বন্দী সেই শৃঙ্খলে এখন বন্দী হতে চলেছে সম্পূর্ণ দেশ।
‘শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, তুমি-আমি, দুর্বিনীত দাসদাসী-
একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আমাদের ঘিরে শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরেস্তরে শেকলের ঝংকার।’
 মানুষ তবু ভুলতে পারে না-
‘তোমার দীর্ঘশ^াসের নাম চ-ীদাস
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রু বিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম’

দুর্বৃত্তদের নিকট আত্মসমর্পণ করছে সব জনগণ এমনকি মুক্তিযোদ্ধারা, সকলে হয়ে উঠেছে অসহায় পঙ্গু। জাতীয় শব্দই যেন হয়ে উঠেছে ‘পঙ্গু’। ‘পঙ্গুত্ব’ হয়ে উঠেছে জাতীয় চরিত্র। কেউ কেউ দেশপ্রেম আর যুদ্ধেও অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও হয়ে উঠেছে স্বৈরাচারদের দোসর। এটি এমন একটি উর্বর দেশ যেখানে রক্তের দাগ মুছে যাবার পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাদেরও করা হয় বিতর্কিত। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্যে প্রাণ দেওয়া বাঙালিরা চেয়ে চেয়ে দেখে তাদের দেশ হয়ে উঠছে বাঙলাস্তান। আমার চোখের সামনে, (য.গ.যা.ম.য.ও.যা.নী)  ‘এ-জন্যই কি আমি হাজার হাজার বছর ধ’রে অরণ্যের ভেতর দিয়ে , নদীর জল সাঁতরিয়ে, খালের পার দিয়ে, পাহাড়ের চ’ড়ো ডিঙ্গিয়ে, আলকাতরা কংক্রিট পেরিয়ে, সাঁকো পার হয়ে তোমার দিকে আসছিলাম ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইলের সবুজ রূপসী?’ নাম পরিচয়হীন যে -কোন একজন নিহত মুক্তিযোদ্ধার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা, হুমায়ুন আজাদ।
গরু আর গাধা দিয়েই ভরে উঠছে দেশ, মানুষ যেন দিনে দিনে হয়ে উঠছে গরু আর গাধা প্রেমি। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর, গরু ও গাধা, সিংহ ও গাধা ও অন্যান্য, অনেক দেখেছি, পৃথিবীতে একটিও বন্দুক থাকবে না  প্রভৃতি কবিতায় ফিরে ফিরে আসে গরু - গাধাদের প্রসঙ্গ।  তিনি তার মেয়েকে চিরিয়াখানায় নিয়ে যান, তাঁর মেয়ে হরিণ দেখে মুগ্ধ হয়, মুগ্ধ হয় খরগোশ দেখে আবার গাধার রূপও তাকে মুগ্ধ করে। কবি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বোধ করি; আর বারবার ভাবি/ যদি ওর মতো আমারও সব কিছু ভালো লাগতো। গরু ও গাধা কবিতায় বলেন, ‘অমর ও জীবিত গরু ও গাধায় ভ’রে উঠছে বঙ্গদেশ; যশ খ্যাতি
ঈদ প্রতিপত্তি তাদেরই পদতলে। সিংহ নেই,
হরিণেরা মৃত; এ-সুযোগের বঙ্গদেশ ভ’রে গেছে
শক্তিমান গরু ও গাধায়।’
 এসবের মধ্যে কবির প্রতীতি হয় যে, তিনি জন্ম নিয়েছেন অন্যদের সময়ে। এ সময়, এদেশ হয়তো তাঁর নয়। তাঁর খাদ্যে ছিলো অন্যদের আঙুলের ছাপ, পানীয়তে জীবাণু; ওরা শ্যাওলা-পড়া ভাষা আর সুর মুখে পুরে দিয়েছিল, বাধ্য করেছে ময়লা –স্বপ্ন দেখতে, ওরা বাসি মাংসের টুকরো পাওয়াকে ভাবতো সাফল্য, নতজানু হওয়াকে ভাবতো গৌরব, কুঁজকে মনে করতো পদক, শেকলকে মনে করতো অলংকার-এরূপ আরো কত অসংখ্যগুণে ওরা ছিলো বিভূষিত। এরাই শাসন করেছে পৃথিবী দশকে দশকে, পৃথিবীর পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস ওদেরই বিজয়ের ইতিহাস। গরু আর গাধাদের এপর্যায়ে কবি জল্লাদ বলে অভিহিত করেন র্নিদ্বিধায়। কথা দিয়েছিলাম তোমাকে, (আ. বে.ছি অ.স)
কবির বিদ্রোহ আরো তীব্ররূপ ধারণ করেছে-
‘যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর-
সে তুমি কেমন ক’রে,বাঙলা, সে তুমি কেমন ক’রে
দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছো পালে পালে শুয়োকুকুর?’
                                       যে ফুল ফোটাও তুমি, আ.বেঁ.ছি.অ.স
গর্ভধারিণী মা জানে না তার গর্ভে জন্ম নেবে সে গোলাম না মানুষ, সেই নারী কোন একদিন জন্ম নিয়েছিলেন কোন এক দরিদ্র পিতার গৃহে, দুঃক্ষের সংসারে কুমড়ো ফুলের মতো ফুটেছেন ঢলঢল, ভাঙা পালকিতে চড়ে গিয়েছেন স্বামীর বাড়ি, প্রথাসিদ্ধ ভক্তিতে তার কেটেছে জীবন। তার সন্তান হতে পারত সৎ কৃষিজীবী বা, মেরুদ-সম্পন্ন শ্রমজীবী কিংবা তিতাসের অপরাজেয় ধীবর। কিন্তু পুঁজির নির্মম শাসনে সে নদী আর মাঠ ভুলে হয়ে ওঠে হাবশি গোলাম এখন সে প্রভুদের পাদুকার তলে প’ড়ে থাকা অন্ন চেটে খাওয়া ছাড়া আর কিছুতেই তৃপ্তি পায় না।

‘এখন সে শত্রু পাখি
ও নদীর, শত্রু মানুষের, এমনকি সে আপনার
স¯াÍনেরও শত্রু। তার জন্যে দুঃক্ষ করি না, কতোই
তো গোলাম দেখলাম এ-বদ্বীপে শতকে শতকে।..
আপনার পুত্রের গোলামির বার্তা আজ
রাষ্ট্র দিকে দিকে, নিশ্চয়ই তা পৌঁছে গেছে তিতাসের
জলের গভীওে আর কুমড়ো খেতে, লাউয়ের
মাচাঁয়, পাখির বাসা আর চাষীদের উঠোনের কোণে।’
                                    গোলামের গর্ভধারিণী, আ.বেঁ.ছি.অ.স

রাজনীতিবিদগণকে দেখলেই কবির মনে হয় যেন দু চোখ অন্ধ হয়ে যাবে আর কোন দিনই দেখতে পাবেন না। তাদের দেখলে শিশুরা কেঁদে ওঠে, নারীরা অমঙ্গল আশঙ্কা করে দুয়ার বন্ধ করে দিতে চায়, নদীতে চর জেগে ওঠে-ছাইয়ে ঢেকে যায় ধানখেত মধুমতি মেঘনার তীর। তাদের দেখলে কবির মনে হয় কখনো কাউকে জড়িয়ে ধরেননি, যেন চিরকাল কবরই খুঁড়েছেন, মাটির তলদেশ থেকে কেবল উঠে আসে খুলি আর খুলি। রাজনীতিবিদদেও দেখলে বজ্রপাত হয় নীল থেকে, পোকাজন্মে আ¤্রফলে, শবরিতে; ইক্ষুর শরীরে দেখা দেয় কালান্তক বিষ।প’চে ওঠে পাকা ধান, পঙ্গপালে সাবাড় কওে সবুজ মাঠ।
‘যখন তাদের দেখি হঠাৎ আগুন লাগে চাষীদের মেয়েদের
বিব্রত আঁচলে; সমস্ত শহর জুড়ে শুরু হয়, খুন, লুঠ, সম্মিলিত অবাধ ধর্ষণ,
 ভেঙে পড়ে শিল্পকলা, গদ্যপদ্য; দাউদাউ পোড়ে পৃষ্ঠা সমস্ত গ্রন্থের;
ডাল থেকে গোঙিয়ে লটিয়ে পড়ে ডানা ভাঙা নিঃসঙ্গ দোয়েল,
আর্তনাদ করে বাঁশি যখন ওঠেন মঞ্চে রাজনীতিবিদগণ।’
                                             রাজনীতিবিদগণ, কা.মো.অ.বি

জীবনের সায়াহ্নে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সুখি ছিলেন না কিন্তু তিনি মানুষের ওপর বিশ^াস হারাতে উৎসাহিত করেননি। হুমায়ুন আজাদ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে বলেন-
‘মানুষের সঙ্গ ছাড়া আর সব ভালো লাগে; অতিশয় দূওে বেঁচে আছি,
পথের কুকুর দেখে মুগ্ধ হই, দেখি দূরে আজো ওড়ে মুখর মৌমাছি।,
                                                  মানুষের সঙ্গ ছাড়া, পে. কি.নে
ধুধু মাঠ, নদী, পাহাড়, মরুভূমি –সব পেরিয়ে এসে কবির মনে হয় আর পেরুনোর কিছু নেই, নিস্তব্ধ অন্ধকারে পেঁচার মত বসে থাকা ব্যতীত এখন যেন আর কিছুই করার নেই, এখানে পাখা ঝাপটে ডুবে যায় রাজহাঁস (পঙ্কিল রাজহাস), বাংলার মাঠে মাঠে বিচরণ করছে কোটি কোটি গাধা (অনেক দেখেছি)। ‘হ্যামেলিনের বাঁশিঅলার প্রতি আবেদন’ কবিতায় কবি বাঁশিঅলাকে আহ্বান করেছেন যেন সব শিশুদের দূর থেকে দূরে কোনো উপত্যকা বা পাহাড়ের পবিত্র গুহায় লুকিয়ে রাখে, পৌরপিতাদের পাপ যেনো না লাগে তাদের আত্মায়।  অবশেষে ক্লান্ত অবসন্ন কবি  নিমজ্জিত হন প্রেম-প্রকৃতি ক্ষণকালীক ভাবনায়, সব ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়তে চান-‘আমি ভুগছি ঘৃণার কৃষ্ণতম জ¦রে,/
এক পা-ও না ফেলে এখনি আমার পথের ওপর
ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।’
                    ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, পে. কি.নে

হুমায়ুন আজাদের প্রথাবিরোধিতা বিদ্রোহী চেতনারই প্রচ্ছন্ন রূপ। একজন তরুণ সমালোচক বলেছেন, ‘যে প্রথা মানুষকে নিশান্ত আশ্রয়ের সন্ধান দিতে পারে না সেই প্রথাকে প্রত্যাখান করেন তিনি; তাহলে কি কবির প্রথাবিরোধিতা উল্টো ¯্রােতে চলা? না, তা নয় তাঁর প্রথাবিরোধিতা বরং আত্মপোলব্ধির দিগন্ত উন্মোচন।’ তিনি আজীবন সব কিছু ভেঙে পড়তেই দেখেছেন, অমীমাংসীত দীর্ঘ লড়াই দেখতে দেখতে ক্লান্ত কবি তবুও বোদলেয়ারের মত ক্লেদাক্ত পঙ্কে নিমজ্জিত থাকেন না। নিরাশার সঙ্গে আশার কথাও শুনিয়েছেন, ভাঙার সঙ্গে গড়ার স্বপ্নও তাঁর ছিল। মধ্যপন্থায় বিশ^াসী নন তিনি, কাব্য চেতনা বিবর্তনে যেমন তাঁর হতাশাকে ধীরে ধীরে আরও ঘনীভূত হতে দেখা যায় এর সব কিছু বদলে ফেলার ,তৈরি করার বানীও বলে গেছেন; অবিমিশ্র কেবল হতাশাই তাঁর কাব্যের মূলধারা নয়। ‘স্বৈরতন্ত্র ছাড়া মানুষ আর সভ্যতার কোনো বর্তমান,ভবিষ্যৎ নেই’, যতোবার জন্ম নিই, স.কি.ন.অ.যা; এই কথার বিপরীতে ‘পৃথিবীতে একটিও বন্দুক থাকবে না’ অভিব্যক্তি হিসেবে অনেক বেশি তীব্র ও সত্য বলে মনে হয়।
‘এদেশ বদলে যাবে, বদলে দেবে শ্রমিকেরা , অতীন্দ্রিয় ছাপ্পান্নো হাজার
বর্গমাইল শুদ্ধতা পাবে মিলিত মেধায়। পরিশুদ্ধি পাবে সব কিছু,
পদ্যপুঞ্জ পুনরায় উঠবে কবিতা হ’য়ে, পরিশুদ্ধ পাঁচটি স্তবকে
শুদ্ধি পাবে সমগ্র রবীন্দ্রকাব্য, একটি ধ্বনিতে ছেঁকে তোলা হবে ঐশী
গীতবিতানের স্বরমালা।..আমার সামনে কোন মধ্য পথ ছিল না -থাকবে না।’
                                                          একাকী কোরাস, জ¦.চি.বা

‘ভিখারী’ কবিতায় কবি বলেন, বাঙালিরা অত্যন্ত গরীব আর ভিখারী। এই দরিদ্রদের কোন কিছুই সুন্দর নয়। তাদেও বাড়িঘর, পোশাক, হাঁটা, খাওয়ার ধরণ, ঘুমোনোর ভঙ্গি, হাসি গান গাওয়া, আলিঙ্গ, কিছুই সুন্দর নয়। তাদের মাথায় উকুন আর জট ছাড়া কিছু নেই, তাদের চোখের চাহনি ড্যাবড্যাবে, মেয়েদের স্তনও শুকিয়ে ফোড়া হয়ে যায়-‘শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়।’
                                                               গরিবদেও সৌন্দর্য, য.গ.যা.ম.য.ও.যা.নী
বন্ধুরা, আপনারা কি জানেন আপনারা শোষণ উৎপাদন করছেন, (আ.বেঁ.ছি.অ.স ) কবিতায় হুমায়ুন আজাদ শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বলেন-
‘একটা সুইচ বন্ধ করলে আপনারা
                       শোষণের একটা সইচ বন্ধ করেন।
একটা চাকা বন্ধ করলে
                        আপনারা শোষণের একটা চাকা বন্ধ করেন।’

হুমায়ুন আজাদ বাস্তবতার চিত্র অঙ্কণ করেছেন, নিরাশার বাণীকে বড় করে তোলেননি। সব বৃক্ষই শীতের পরে নতুন পাতা ফিরে পায়, হুমায়ুন আজাদ বলেন-
 ‘এই গ্রাম আজ
নতুন মানুষ আর প্রকৃতির, যা ছিল আমার আর ওই হিজলের;
 আমি বুঝতে পারি একই সুতোয় গাঁথা মানুষ ও প্রকৃতি একইভাবে
বাঁচে মরে, পুরোনো গাছের পর দেখা দেয় নতুন গাছেরা।’
                                             মানুষ ও প্রকৃতি একইভাবে বাঁচে মরে, কা.মো.অ.বি
চল্লিশ বছর বাইরে থেকেছি –ছিন্নমূল আর বহিরস্থিত;
এবার বাঁধবো ঘর নদী কিংবা পুকুরের পাড়ে;
একটি নারীও হয়তো থাকবে সঙ্গে নিবিড় সুস্মিত।
 আবার গুছিয়ে তুলবো দুঃখ আর দীর্ঘশ^াসগুলো ভাঙাচোরা বুকে;
একটি দুপুর ভ’রে অন্তত তুলবো বাঁশি কিংবা বেহালায় সুর,
ঋুলে যাবো একটি সম্পূর্ণ শতক কেটেছে অসুখে।’
                                                    দ্যাখো আমি, কা.মো. অ.বি

প্রেম ও প্রকৃতি
প্রেমের কবিতায় বিপরীত লিঙ্গের ভূমিকা অনিবার্য, নারীবাদী ভাবনাই অনেকাংশে  হুমায়ুন আজাদের প্রেমের কবিতার ভাব-ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে; ‘পুরুষ উদ্ভাবন করেছে নারী সম্পর্কে একটি বড়ো মিথ্যা, যাকে সে বলেছে চিরন্তনী নারী। তাকে বলেছে দেবী, শাশ^তী, কল্যাণী, গৃহলক্ষ¥ী, অর্ধেক কল্পনা; কিন্তু পুরুষ চেয়েছে ‘চিরন্তনী দাসী’। ৭ নারী, হুমায়ুন আজাদ, পৃ. ১৪  ‘মনুষ্য জাতির পরাজিত লিঙ্গের নাম নারী’ ৮ প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭ রাষ্ট্র ও পরিবার শোষণের হাতিয়ার , রাষ্ট্র শোষন করে মানুষকে আর পরিবার শোষণ করে  নারীকে -এসব আধুনিক চিন্তা হুমায়ুন আজাদকে প্রভাবিত করেছিল  তাই তিনি বিবাহে বিশ^াসী নন। তিনি প্রেমের চেয়ে কামকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, যার কোন আশ্রয় নেই সেই প্রেমে সন্ধান করে আশ্রয়, এই প্রেম ইউরোপীয় রোমান্টিকদের সৃষ্টি এর পূর্বে প্রেম ছিল না, ছিল শুধু কাম।  মাদাম বোভারি, লেডি চ্যাটার্লি’স লাভার তাঁর প্রেম ও নারী ভাবনার পরিপ্রেক্ষিত। তাঁর প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থে যে প্রেমভাবনা পাওয়া যায় সেখানে তিনি রোমান্টিক, ভাবুক কিন্তু স্বকীয় নন। উত্তরোত্তর তাঁর প্রেম ভাবনা স্বকীয়তার সন্ধান পেয়েছে। তিনি নন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত রোমান্টিক নন জীবনানন্দেও মত বিষণœ প্রেমিক তাঁর প্রেম নারীর সাম্য চেতনা ও দেহজ কামনার শিথিল অনুশাসনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রথাবিরোধী হুমায়ুন আজাদকে রোমান্টিক হিসেবে কল্পনা করা সহজ নয়, বাস্তবতা তাঁর রোমান্টিক চেতনাকে প্রস্ফুটিত হতে দেয়নি তবুও তাঁর রোমান্টিকতাকে অস্বীকার করা চলে না। প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাগুলোতে তাঁর রোমান্টিকতা স্পষ্ট। ‘হুমায়ুন আধুনিক, প্রথাবিরোধী বলে রোম্যান্টিকতা থেকে তাঁকে খারিজ করবেন না। সে অন্যদের চেয়ে বেশি রোম্যান্টিক।’ ৯ হুমায়ুন আজাদ, মোহাম্মদ আলী, পৃ. ১১৩ হুমায়ুন আজাদের রোমান্টিকতা আবেশ সৃষ্টি করে না বা বিষণœ কওে না, তাঁর রোমান্টিকতা মানস নেত্রে চিত্রের নির্মান করে, উদ্রেক করে চিন্তা, পাঠক কবিতার চিত্রগুলোকে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে আত্মচেতনায় নিমগ্ন হন।
হুমায়ুন আজাদের প্রথম পর্যায়ের প্রেমের কবিতাগুলোতে প্রথাগত প্রেম ভাবনাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়নি। তবুও এ পর্যায়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের অনন্ত প্রেম, নিষ্কাম প্রেম বা বিশুদ্ধ প্রেমে আস্থাশীল নন। এখানে তিনি ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’,‘ অর্কেস্ট্রা’ কাব্যের আঙ্গিকে শিল্পীত ব্যঞ্জনায় প্রেম ভাবনাকে উন্মোচন করেছেন। কাব্যে শিল্পের কারুকাজ, অর্থ দ্বৈধতা, টুইস্ট এনডিং, ভাববিলাসিতা এ পর্যায়ের প্রেম বিষয়ক কবিতার বৈশিষ্ট্য। কোন কোন ক্ষেত্রে শিল্প অতিক্রম করতে চায় বাণীকে ।  বাঘিনী, রাত্রি, যদি তুমি আসো, পাপ,থাবা, এরপর যেনো প্রভৃতি কবিতায় জীবনানন্দ দাশ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব স্পষ্ট। একলা দেখতে নেই, এইভাবে নয়? কবিতা দুটোতে স্পষ্টরূপ পেয়েছে হুমায়ুন আজাদের যৌন চিন্তা । হুমায়ুন আজাদের প্রেম বিষয়ক কবিতাগুলোকে স্থ’ূলভাবে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়; শিল্পীত হৃদয়ের ভাববিলাস, প্রেমিকের প্রেমাবেগ,  নারীবাদী চেতনা ও প্রেম বিষয়ক ক্ষণিক ভাবনা।
প্রথম পর্যায়ের কবিতায় হুমায়ুন আজাদ দার্শনিক নন, নারীবাদী নন, তাঁর নেই কোন অভিযোগ বা বিশেষ ভাবনা-

‘দেখি না কিছুই চরাচর নক্ষত্র সমুদ্র জলযান
দেখি না নিজেকে কররেখা নিজ ছায়া কিছুই দেখি না
আমার দু-চোখে অক্টোবরের গাঢ় সন্ধ্যা
তার মধ্যে নিরবধি কান্না হয়ে তুমি ব’সে আছো’
                                       রোদনের স্মৃতি, অ. ই

‘হে আমার প্রেম, গুপ্ত ঘরে চুপিসারে জন্ম-পাওয়া অবৈধ সন্তান।
..
সে-তোমাকে যখন করাই দাঁড় সদর রাস্তায়
ঘেন্নায় শিউরে ওঠে সরল যুবতী
ভেঙে
         পথঘাট
                দেবালয়
ভয়াল শব্দের সঙ্গে ধ’সে পড়ে পবিত্র নগরী।
                               প্রেম ভালোবাসা, অ.ই
 ‘হ’তে যদি তুমি সুন্দরবনে মৃগী
অথবা হংসী শৈবাল হ্রদে বুনো’
                            পাপ, জ¦.চি

কিছু কিছু কবিতায়  প্রেমিক হৃদয় থেকে উদ্ভূত ভাবাবেগই প্রধান ¯্রােত হয়ে উঠেছে-
‘যদি তুমি আসো তবে এ-শহর ধন্য হবে
একটি তুচ্ছ যান
আবার রাস্তা খুঁজে পাবে
প্রতিটি ট্রাফিক সিগনাল নির্ভল সংকেত দেবে
রাস্তায় ঘরে ঘুমে স্বপ্নে পুস্তকে
 গোলাপ পাপড়িতে যদি তুমি আসো’
                                                 যদি তুমি আসো, অ.ই

হুমায়ুন আজাদের  এক শ্রেণির কবিতা রয়েছে যেখানে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, কামনা-বাসনাই প্রধান হয়ে উঠেছে, অবদমিত কামনা, বিরোহী স্মৃতিচারণ, ব্যর্থপ্রেম থেকে উদ্ভূত জীবনা ভাবনা, মিলন-বিরহ, ক্ষণিক জীবন ভাবনা এসব কবিতায় প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদের শিল্প একান্ত তাঁর স্বকীয়, স্বতন্ত্র বিষয় চেতানাই শিল্পস্বাতন্ত্র তৈরি করেছে। এখানে কবি কখনো প্রেয়সীকে বেদনার সঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছেন, দেহজ কামনাই হয়ে উঠেছে প্রধান প্রভাবক, জীবনানন্দ সুরঞ্জনাকে অপর যুবকের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছেন হুমায়ুন আজাদ উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় ত্যাগ বা সংযমের প্রাধান্য নেই। তাঁর কোন কোন কবিতায় রাবিন্দ্রীক রোমান্টিকতার পরিবর্তে বিহারীলালের অকারণ হাহাকারই প্রধান হয়ে উঠতে দেখা যায়। কখনো কখনো নেমে আসে জীবনানন্দীয় বিষণœতা। আবার কোথাও কোথাও ‘অর্কেস্ট্রা’র সুর শোনা যায়। তাঁর প্রেয়সী নারী ঊর্বসী নয় কেউই তারা আর্টেমিসের প্রতিভূ ‘একাদশ প্রেম’ কবিতায় কবি জানেন তাঁর প্রেমাস্পদ ইতোপূর্বে অভিজ্ঞ হয়ে এসেছে তাতেও তাঁর বিরূপতা নেই। আবার নারীবাদী বলে স্বপ্রচারিত নারীরা যারা শেষ পর্যন্ত বিবাহ তথা প্রথাগত জীবনেই প্রত্যাবর্তন করতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে রচনা করেন ‘রান্নাঘরে নারীবাদী’।

 ‘কিন্তু অই লোকটি, যে তোমাকে নিয়ে শোয় প্রতিরাত
কিন্তু অই লোকটি, যে তোমাকে কাছে পায় প্রতিদিন
কিন্তু অই লোকটি, যে তোমাকে জমজমাট গর্ভবতী করে বছর বছর
সে কেনো একটি আস্ত গাধা হ’য়ে যাচ্ছে দিন দিন!
তুমি যাকে দেহ দাও, তাকে গাধা করো
তুমি যাকে স্বপ্ন দাও, তাকে সোনা করো!’
                            তুমি সোনা আর গাধা করো, স.কি.ন.অ.যা

‘যে –দিকে ফেরাও মুখ সেদিকেই আবির্ভূত অমল সুন্দর।
..
যে-দিকে তাকাও তুমি সেদিকেই অভাবিত অনন্ত কল্যাণ
..
তুমি তো তাকাও সব দিকে; শুধূ আমার মুখের দিকে,
মানুষের দুরূহতম দুঃক্ষের দিকে, এক শতাব্দীতে
একবারো-ভুলেও তাকালে না।’
                               তরুণী সন্ত, আ.বে.ছি.অ.স

হুমায়ুন আজাদের নারীবাদ অনেক সময় নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ করে তোলে, বাংলাদেশে উগ্র নারীবাদ অনেক সময় কাক্সিক্ষত ফল প্রদান করেনি। ১০ প্রাচুর্যে রিক্ততা, আবুল কাসেম ফজলুল হক, পৃ. ৪০  কাহলিল জিবরান নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ না করেও নারীকে দিয়েছেন পুরুষের সমকক্ষতা কেননা যখন দুটি ওক গাছ পরস্পরের মুখোমুখি হয় তখন তারা একে অপরের সমান উচ্চতায় দাঁড়িয়ে থাকে। ১১ প্রফেট, কাহলিল জিবরান

‘আমি জানি তুমি ওষ্ঠ রেখেছো অনেক ঠোঁটে;
তুমি জানো আমি ওষ্ঠ রেখেছি অনেক স্তনে।
তবুও তোমার দুই নীল চোখে পদ্ম ফোটে,
সুদূর কোকিল ডাকে বারবার আমের বনে।’
                একাদশ প্রেম, পে.কি.নে

‘নারীবাদী আমি, বলেছিলে ‘খুবই ঘৃণা করি প্রেম আর বিয়ে,
প্রেম বাজে কথা; বিয়ে? ওহ্ গশ্! খুবই নোংরা কাজ।’
..
কেঁপে উঠেছিল বুক সেই রাতে; বেশি নয়, আট মাস পরে
ঊলেছিলে, ‘চলো বিয়ে করি, আমার এখন বিয়ে ইচ্ছে ভারি।’
চুমো থেকে পিছলে পড়েছি, ফিরেছি নিজের ঘরে;
‘চলো বিয়ে করি, চলো বিয়ে করি’,প্রতিটি চুমোর পরে;
এভাবেই, প্রিয়, একদিন হলো আমাদের চিরকাল ছাড়াছাড়ি।’
                                       রান্নাঘরে নারীবাদী, পে.কি.নে   




প্রেম বিষয়ক ছোট ছোট ভাবনাও কখনো কখনো কবিচিত্তকে কম্পিত করেছে-

‘আজ থেকে খুব ধীরে পুড়ে যাবে চাঁদ
খুব সুস্থ হ’য়ে উঠবে জীবন যাপন।
অন্নে জলে ঘ্রাণে পাবো অবিকল স্বাদ,
চিনবো শত্রুর মুখ, কারা-বা আপন।
বুঝবো নিদ্রার জন্যে রাত্রি চিরদিন,
যারা থাকে ঘুমহীন তারা গায় গান।
রঙিন রক্তের লক্ষ্য ঠা-া কফিন;
খুব চমৎকার লাগছে লিলিআন।’
                            প্রেমিকার মৃত্যুতে, জ¦.চি.বা

দেশের ভাবনা যেমন কবিকে ক্লান্ত ও বিষণœ করে তুলেছে প্রেমের ভাবনাও কবিকে একই পথে নিয়ে যায়, ব্যর্থতা, দীর্ঘশ^াস, অচরিতার্থতার মধ্যেও মোহময় স্মৃতিরা বেঁচে থাকে; তিনি প্রেমে বিশ^াসী নন তাই হয়তো প্রেম চেতনা তাঁকে শেষ পর্যন্ত কোন কল্পিত মোহময় স্বর্গলোকে নিয়ে যায় না। তাঁর প্রেম বাস্তবতার জটিলতায় আবর্তিত হয়ে কবি হৃদয়কে অপ্রাপ্তির বেদনায় বিক্ষত করেছে-

‘তোমার কথাও মনে পড়ে না
আর, এতোখানি ম’রে আছি; এবং যখন
মনে পড়ে তোমাকে ভেবেও আর
কষ্ট পাই না, এতোখানি
ম’রে আছি। দুপুরে ঘুমোই,
মাঝরাতেও একবারও
ভাঙে না ঘুম, বুকের ভেতরে কোনো
দাঁত বেঁধে না আর, এতোখানি
ম’রে আছি।’
                       এতোখানি ম’রে আছি, কা.মো.অ.বি

‘বিস্বাদ লেগেছে চারদিক-মাছ, ভাত,
দুধ। গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ ফোটে না আজ আর বাগানে ও বুকে;
এমনকি নদী, চাঁদ, ঘাসফুল,তারার আকাশ, দিঘি,দিগন্ত,শুকতারা
এখন দেখি না আর তাকিয়ে তোমার অতি পরিচিত মুখে।’
                                     কিছুই আগের মতো নয়, পে.কি.নে

হুমায়ুন আজাদ প্রকৃতিকে উপলব্ধি করেছেন জীবনোপলব্ধি থেকে, তাঁর দেশ প্রেম প্রকৃতি প্রেমেরই পরিবর্তিত রূপ। তিনি ভালোবাসতেন সন্ধ্যাতারা-নক্ষত্রম-লী, পল্লীর ধান খেত, গ্রামীণ বন, ছোট নদী-বালুচর, ভালোবাসতেন পাখি, মাছ, শ্যাওলা, কাশবন। হুমায়ুন আজাদের প্রকৃতি ছিল আবহমান ধরে চলে আসা গ্রামীন প্রকৃতি-এই প্রকৃতি দেখেছে ‘পথের পাঁচালী’র অপু, দেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন। বাংলার প্রকৃতি তৈরি করেছিল আউল-বাউল, রাখালী-ভাটিয়ালিসহ নানা মধুর সুর  কিন্তু তিনি আউল-বাউল বা রাখাল হতে চাননি, প্রকৃতিকে তিনি দেখেছেন রোমান্টিক দৃষ্টিতে। নির্জন মাঠে, নিবিঢ় বনে বা বিলে –ঝিলে পাখিদের গান গাইতে দেখে তিনি নিজেকে ওদেরই অঙ্গীভূত করে নিয়েছেন, ফুল,পাখি, মাছ, বৃক্ষ, বন,নদী তাঁকে করেছে দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ কিন্তু তিনি মনোরম এই দেশকে বারবার বিপথগামী হতে দেখেছেন তাই তাঁর প্রকৃতিপ্রেমের কবিতা নিখাঁত প্রকৃতি প্রেমের কবিতা নয়। মৌমাছিরা নিজের বাসা আক্রান্ত হতে দেখলে ক্রুদ্ধ হয় তিনিও ক্রুদ্ধ হয়েছেন; বারবার বলেছেন কী কওে অপরূপা এই দেশ নষ্টদের অধিকারে যায়। শিশুর মতো তিনি দেশকে ভালোবাসতে পারেননি কারণ শিশুরা জানে না দেশ কোন অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, রোমান্টিক কবিদেও মত তিনি থাকতে পারেননি নিস্পৃহ, প্রতিবাদের ভাষাকে তিনি কখনোই বর্জন করেননি। নষ্টরা দেশ বিনষ্ট করছে, তিনি প্রেমের কবিতা লিখতে অপরাধবোধে ভোগেন, প্রকৃতির রূপ উপভোগ করতে গিয়েও জাগ্রত হয় অপরাধবোধ। কোন কোন সময় নিজেকেও নষ্টদের একজন বলে মনে হয়। ‘আমি আক্রান্ত হই, সেগুলো সম্পর্কেও আমি নিশ্চিত নই এবং কখনো কখনো তো ঘাসের দিকে তাকিয়েও আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়, কখনো আকাশের দিকে তাকিয়েও অপরাধী ব’লে মনে হয়, কখনো মনে পড়ে যে আমি কথা রাখি নি, তখনো অপরাধবোধ জেগে ওঠে; এর তালিকা অন্তহীন হবে।’
১২ হুমায়ুন আজাদ, মোহাম্মদ আলী, পৃ. ১২৬
 রাড়িখালে কেটেছে তাঁর সাড়ে পনের বছর, এরপর দীর্ঘদিন তিনি অতিবাহিত করেছেন গ্রামের বাইরে কিন্তু গ্রামীন প্রকৃতির রূপ আর কোথাও দেখেননি। তিনি বলেন, ‘সাড়ে পনেরো বছর ধ’রে মায়ের আদওে রাড়িখালের মাটি জল বাতাস মেঘ ঘাস জ্যোৎ¯œা রোদ অন্ধকার কালবোশেখি আশি^নের ঝড় আমার ভেতরে ঢুকেছে; চোত মাসে ঢুকেছে নিবিড় ঘন হয়ে আসা সবুজ, বোশেখে প্রচ- সূর্যের অগ্নি, ঢুকেছে হঠাৎ ঝলমল খলখল ক’রে আসা জৈষ্ঠ্যের জোয়ার, ঢুকেছে আষাঢ় শ্রাবণ ভাদ্রের বিপুল বন্যা, শরৎ ও হেমন্তের সোনা ও কুয়াশা, মাঘের শিশির, আমার ভেতওে বিছিয়ে থেকেছে সোনালি ধান। আমার ভেতর বুনেছে স্বপ্ন। আমি আজো তার গন্ধ পাই, রূপ দেখি।’ ‘চোখ বুজলে দেখতে পাই অজ¯্র দৃশ্য, দৃশ্যের পর দৃশ্য, রঙের পর রঙ,-অন্তহীন এক চিত্রশালা চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে ওঠে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্যালারির থেকেও তা সমৃদ্ধ; পাই ঘ্রাণ-জলের,প্যাঁকের, কড়িফুলে, গন্ধরাজ, কচুরিপানা, ঘাস, মাছ, শ্যাওলা, হিজলের। দেখতে পাই দইকুলি এসে বসেছে আমের ছোটো গাছটিতে, টুনটুন করছে টুনটুনি শাদা বেগুনের ডালে, বাবুই নিবিড় বাসা বুনে যাচ্ছে খেজুর ডালে;’ ১৩ ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য, হুমায়ুন আজাদ, পৃ.৮০
 একাধিক লেখায় হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘পার্বতীপুরে একটি নদী দেখেছিলাম, নামও ভুলে গেছি, না-কি ওর নাম কাঁকড়া, বয়ে চলেছে আমার রক্তের ভেতর দিয়ে, ঝকঝক করছে ওর মুক্তোর মতো বালুকণা। ওটি এতো ছোট যে দুই হাতে জড়িয়ে ধ’রে বুকে ক’রে অনেক দূরে চ’লে যাওয়া যায়। শ্রীমঙ্গলের ধলাইও তাই, তবে ওটি খুবই বিষণœ
নদী, যেনো ভয়ে আছে ম’রে যাওয়ার, কিন্তু ম’রে গেলেও আমার ভেতরে বেঁচে থাকবে।’ ১৪ ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য, হুমায়ুন আজাদ, পৃ.৩১
‘আমার পাখিরা’ প্রবন্ধে বলেছেন, চোত মাসে যখন চারদিক খাঁখাঁ করতো, আর পশ্চিমের ছাড়াবাড়িটাতে বুক ভ’রে কাঁদতে শুরু করতো ধূসর ঘুঘুটি, আমার বুকে হাহাকার শুরু হতো।’
 পুকুরের পাড়েই ছিলো ঝোপঝাড়, তাতে থাকতো লম্বা গলার লম্বা পায়ের ডাহুকেরা। দুপুরে বা রাতে তারা ডাকতো মত্ত বাউলে লালন ফকিরের মতো; অদ্ভুত তাদের গলার আওয়াজ। কচুরিপানার ওপর দিয়ে তাদেও হাঁচটার ভঙ্গি ছিল দেখার মত। নৌকো নিয়ে আমরা ধানখেতে ঢুকতাম। শুনতাম সেই পাখিটার থেকে থেকে ‘ডুব, ডুব’ গভীর আওয়াজ।’
হুমায়ুন আজাদের কবিতায় প্রকৃতি এসেছে নানা রূপে, তিনি পৃকৃতিকে কেবল দূর থেকেই অবলোকন করেননি-প্রকৃতির সঙ্গে হয়ে উঠেছেন একাত্ম। প্রথম কাব্যে প্রকৃতিকে দেখেছেন তারুণ্যের আবেগের ভিতর দিয়ে সেখানে শিল্পকৌশল প্রকৃতির রূপকে আবেষ্টন করেছে, শিল্পের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নির্ঝরিনীর মধ্য দিয়ে ঝওে পড়েছে প্রকৃতির রঙ রূপ। তিনি কখনো প্রকৃতির লীলা দর্শন করেছন মুগ্ধ চিত্তে, কখনো প্রকৃতির হৃদয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন, কখনোবা স্মৃতিচারণায় প্রকৃতি আরো মোহময় হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি কখনো কখনো হয়ে উঠেছে প্রেমের অনুষঙ্গ।
রাড়িখালের কথা ফিরে এসেছে বারবার কখনো প্রত্যক্ষে কখনোবা স্মৃতি চারণা, ঢাকার মাত্র উনিশ মাইল দূরে রাড়িখাল, ছোট্ট কুঁড়ে ঘর লেপানো থাকে তার উঠোন, বাড়ির উত্তর ধাওে আকাশ ফেড়ে উঠেছে কদম গাছ। পুকুওে ভাসে হাঁস শাপলার থরোথরো ফুলের মতো, ইজার ভরে যায় কেটে আনা তৃণে, নিকটে বয়ে যায় খরাক্রান্ত ছোট নদী। আর থাকে বাল্যকালের খেলার সাথীরা, পাঠশালা থেকে ফেরার পথে কোন কোন দিন তিনি বস্ত্রহীন নেমে যান বিবির পুকুরে। তাঁর খেলার সাথী রাজিয়া বস্ত্র তুলে নিয়ে যায় খলখল হেসে, রাড়িখাল এখনো আছে সেই রাজিয়ার কোন খবর নেই। সেই বাল্যকালে তিনি পাঠশালা থেকে ফিরেছেন পাখির বাসা কুড়িয়ে এনে। মাঘের দুপুরে বাসা ভেঙে দিয়েছেন শালিকের, মেলা থেকে ফিরে ভয় পেয়েছেন তেঁতুল গাছটার তলে শাদা বউ দেখে। মাত্র এক দশক পরেই রাড়িখাল আর পূবের মত নেই। এখানেই বারবার ভাঙতে দেখেছেন দেশ, উপলব্ধি করেছেন ‘কিশোরীর দেহের মতোন একান্ত স্বদেশ’, আড়িয়াল থেকে আসে সোনার গুড়োর মত বোরোধান আর এই ‘নির্জল বাঙলা’য় তিনি মেঘ হয়ে উড়ে যান বিলের ওপর দিয়ে। সেখানে মাঠে মাঠে আছে সহ¯্র ‘প্রফুল্ল ধান গাছ’।

‘আর কোনোখানে নয় শুধু রাড়িখালে এলে
মুহূর্তে আমাকে ঢেকে ফেলে

প্রাচীন কুয়াশা। যে আমাকে জন্ম দিলো হাঁটতে শেখালো
সে-ই আমাকে দেখায়  আজ কবরের কালো।
আমার অপরিচিত আজ রাড়িখালে যা কিছু জীবিত,
..
যে-যুবকেরা একদিন বেড়ার আড়ালে
হঠাৎ ধ’রে চুমো খেতো অনিচ্ছুক যুবতীর গালে,
রাখতো হাত বুকে, তারা আজ নিস্পৃহ কঙ্কাল।
..
না থাকাই সত্য আজ, সত্য শুধু একে একে অনুপস্থিতি।’
                                                 রাড়িখাল এলে, কা.মো.অ.বি
‘হঠাৎ আমার
চোখের সামনে ঝলমল ক’রে ওঠে তিরিশ বছর আগে
এই সব জমি, রঙে আর গন্ধে ভ’রে ওঠে আমার শরীর।
....
এই খেতে তিল হতো, দেখতে পাই, ঘন কালচে
সবুজ পাতায় মেঘলা হয়ে আছে জমিগুলো। দেখতে পাই
হঠাৎ বর্ষা এসে গেছে, থইথই করছে চারদিক, তিল কাটা
হয় নি এখনো
কে যেনো আমাকে ডাকে দরও থেকে আমার হারানো নাম ধ’রে।’
                                                  বিভিন্ন রকম গন্ধ, কা.মো.অ.বি

আড়িয়াল বিল আর রাড়িখালের প্রাকৃতিক নান্দনিকতাই হুমায়ুন আজাদ কেবল উপলব্ধি করেননি, তাঁর প্রথম পর্যায়ের কবিতাগুলোতে প্রকৃতি এসেছে নানা রূপে, শিল্পের অলঙ্কারে সুশোভিত হয়ে এসেছে ওরা, কোথাও আছে দার্শনিকতা কখনোবা তারুণ্যেও ভাবাবেগ-
‘বৃষ্টি নামে-গাছের পাতায়, জানালার শাদা ভীরু কাচে।
ধবল হরিৎ বৃষ্টি, গ’লে যায় গাছ টাওয়ার পাখি ও পাথর।
বৃষ্টির মুখোমুখি রেশম লৌহ মাংস সব পাললিক।
...
আমার শরীর গলে সোঁদামাটি, টেরপাই বুকের বাঁ দিকে
মাটি ঠেলে উদ্ভিদ উঠছে,
আমি তার সরল শেকড়।’
                             বৃষ্টি নামে, অ.ই

‘জ্যোৎ¯œা আমাকে ঠেলে ফেলে দিলো ফুটপাথে
ল্যাম্পপোস্টে সবগুলো গাছের চূড়ায়
এই রাতে। আমি জামা খুলে ঘুমোতে যাবার আগে
জানালায় অনভ্যাসে দাঁড়ালাম
আর অমনি জ্যোৎ¯œা ধাক্কা দিলো
এ কী অধঃপতন আমার!’
                               জ্যোৎ¯œার অত্যাচার, অ.ই
হুমায়ুন আজাদ কেবল প্রকৃতিকে মুগ্ধ চিত্তে দর্শন করেননি, তিনি প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে সর্বদাই একাত্ম কওে অনুভব করেছেন-
‘যদি দেখো কোনো শালগাছ কাঁপছে থরথর ক’রে, তবে জেনো
একুশ বছর আগে ওই শালের ছায়ায় আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম তাকে,
যাকে আমি পাইনি, আর পাবো না কোনো দিন।
যদি কোনো সবুজ ঝোপের নিচে দেখতে পাও অত্যন্ত গোপনে
ঝ’রে প’ড়ে আছে একটা টকটকে লাল ফুল,
তাহলে জেনো সেটি আমাদের ঠোঁট থেকে খ’সে পড়া রক্তিম চুম্বন।’
                                          চন্দ্রাযাত্রীদেও প্রতি, য. গ.যা. ম. য. উ. যা.নী

‘যখন আঠারো তখন আমার সমগ্র বাস্তব-অবাস্তব জুড়ে
বিষণœ চাঁপার গন্ধ, কার্তিকের কুয়াশার মতো
ভাসতো মৃত্যুর দেহের ঘ্রাণ। তার শরীরের করুণ মধুর ঘ্রাণ
একযুগ ধ’রে আমি শুঁকেছি সঙ্গীতে, পূর্ণিমার চাঁদে,
ভাটিয়ালি গানে, মেঘ, শস্য, উথালপাথাল বৃষ্টি,
কবিতার পংক্তি, খাদ্য, পানীয়, প্রতিটি কিশোর-যুবতীর
অসম্ভব, অসহ্য সৌন্দর্যে। তখন যৌবন-
প্রেমে আমি আমার দু-কোটি হাতে পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরতাম।’
                                                      মৃত্যু, আ.বেঁ.ছি.অ.স

কবির প্রকৃতি চেতনা কখনো কখনো হয়ে উঠেছে তীব্রতা ও শ্লেষের উপজীব্য-
‘ হে অশুভ, তুমি ফাল্গুনের ফুল হয়ে এসো
হে অশুভ, তুমি চৈত্রের  কৃষ্ণচূড়া হয়ে এসো’
হে অশুভ, ঝড় হয়ে এসো তুমি বোশেখের প্রত্যেক বিকেলে
হে অশুভ, শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে এসো তুমি অঝোর ধারায়।’                           
                                                এসো, হে অশুভ,য. গ.যা. ম. য. উ. যা.নী

‘আমি বেড়ে উঠছি অবিচল পর্বতের মতো, যখন আমার
পাদদেশে পশুদের কোলাহল, তখন আমার গ্রীবা ঘিরে মেঘ,
বুক জুড়ে বৃষ্টি, আর চূড়োর ওপর ঘন গাঢ় নীল!’
                                                  পর্বত, আ.বেঁ.ছি.অ.স
প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে হুমায়ুন আজাদের প্রেম পূর্ণতা পায় না, প্রিয় জনের জন্যে তিনি প্রকৃতির সব সৌন্দর্য দিয়ে গৃহ সজ্জিত করতে চেয়েছে-
‘আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ’মে আছে ঘরের েেঝ জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে
ঊরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আজ দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক।’
                                 আমার কুঁড়েঘর, কা.মো.অ.বি
জীবন সায়াহ্নে কবির মন বিষণœতায় ভওে ওঠে, মৃত্যু যখন আসন্ন আর দেশ যখন বিপন্ন তখন প্রকৃতিও আর মনকে জাগিয়ে তুলতে পারে না-
‘বিস্বাদ লেগেছে চারদিক-মাছ, ভাত,
দুধ। গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ ফোটে না আজ আর বাগানে ও বুকে;
এমনকি নদী, চাঁদ, ঘাসফুল, তারার আকাশ, দিঘি, দিগন্ত,শুকতারা
এখন দেখি না আর তাকিয়ে তোমার অতি পরিচিত মুখ।’
                                       কিছুই আগের মতো নয়, পে.কি.নে

বাংলাদেশে হুমায়ুন আজাদ প্রাবন্ধিক হিসেবেই বিখ্যাত, তাঁর প্রথা বিরোধিতার কথা সবাই জানেন। অনেকে বলতে চান কবিতার ক্ষেত্রে তিনি ততোটা উল্লেখযোগ্য নন কিন্তু এক্ষেত্রে আরও ভাবার অবকাশ আছে। কবিতা রচনায় তিনি অনুসরণ করেননি কোন প্রচলিত ধারা বরং নিজেই একটি নতুন ধারা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর নির্মিত পথ অনুসরণ করছেন অনেকে, তিনি শুধু কবিতার রূপই বদলে দেননি সুরও বদলে দিয়েছেন। তাঁর স্পষ্টতা ও তীব্রতা অনন্য। তাঁর সময়ে দেখেছি আন্দোলনে -সংগ্রামে দেশের ছাত্র  -জনতা একই সাথে তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিগুলোকে ব্যবহার করেছে বাণী ও শ্লোগান রূপে। তখন ছাত্রদের ও সংগ্রামী মানুষের মুখে মুখে ছিল-সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, রাজনীতিবিদগণ প্রভৃতি কবিতা। তাঁর কবিতার অনেক পঙ্ক্তি প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তাই মনে করার কারণ আছে, হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকবেন আরও অনেকদিন। তিনি ছিলেন প্রথাবিরোধী। তাঁকে বুঝতে পঞ্চাশ বছর সময় লাগবে, এটি তিনিই বলেছেন। বাঙালিরা এখনো তাদের পরিচয়ের মূল সূত্রটি খুঁজে পায়নি তাই তারা ঘুরেফিরে মরছে মধ্যযুগীয় অন্ধকারে। বাংলাদেশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ জন্মেছেন যারা বাঙালিদের নিয়ে যেতে চায় মধ্যযুগীয় অন্ধকারে। কোট-টাই-এর ভেতরে তারা ঢেকে রাখেন আদিম-অসংস্কৃত-অনাধুনিক এক মানুষকে। হুমায়ুন আজাদ আঘাত করেছেন এই দুর্বৃত্তদেরই, এদের কারণে বাঙালিরা হয়তো আরও অনেক বছর পরে আত্মসত্তাকে খুঁেজ পাবে; তখন আবার হুমায়ুন আজাদ হয়ে উঠবেন প্রাসঙ্গিক । বাঙালি সমাজের জন্য এখন খুবই দরকার এনলাইটেনমেন্ট বা রেনেসাঁ-এই রেনেসাঁ বাঙালিকে সম্পূর্ণরূপে আধুনিক করে তুলবে। দূর হবে পুরনো অপসংস্কার-কুসংস্কার, সেই সময় হুমায়ুন আজাদ অবশ্যই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন।
তথ্যসূত্র:
১ মামুনুর রহমান, বাংলা কবিতা
২  আমার নতুন জন্ম, হুমায়ুন আজাদ, পৃ. ৬৪
৩ বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস, শহীদ ইকবাল, পৃ.২০২-২০৩
৪  নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ, অনুপ সাদি, পৃ. ১০৬
 ৫  কবিতা ভাষা মাতৃভাষা, রণেশ দাশগুপ্ত
৬  বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস, শহীদ ইকবাল, পৃ.২০১
৭  নারী, হুমায়ুন আজাদ, পৃ. ১৪
৮ প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭
৯  হুমায়ুন আজাদ, মোহাম্মদ আলী, পৃ. ১১৩
১০ প্রাচুর্যে রিক্ততা, আবুল কাসেম ফজলুল হক, পৃ. ৪০
১১  প্রফেট, কাহলিল জিবরান
১২ হুমায়ুন আজাদ, মোহাম্মদ আলী, পৃ. ১২৬
১৩ ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য, হুমায়ুন আজাদ, পৃ.৮০
১৪ ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য, হুমায়ুন আজাদ, পৃ.৩১



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন