শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১৮

সদর ভাই-এর অমর কাহিনি

নেতার মন ভাল নাই, দল আবার ভাঙিল বলিয়া; তিনি ভাবনায় পড়িলেন। এই সময় আর একটি বিশেষ ঘটনা ঘটিল, ইতিহাসের জন্য এই ঘটনা খুব বেশি আবশ্যক না হইলেও এখানে কিঞ্চিত অপ্রাসঙ্গিক হইবে না, দেশবাসীর অভিজ্ঞতার জন্য কাজে লাগিতে পারে।
নেতা ভাবিলেন, বিপ্লব করিতে হইলে ইঞ্জিনিয়ারের সাথে পরামর্শ করিতে হইবে। ইঞ্জিনিয়ারগণ বড় বড় সেতু বানায়, স্বর্গে যাইবার সিঁড়ি বানাইয়া দেয়, সাগরের তলে হাঁটিবার রাস্তা বানাইয়া দেয় তাই ইঞ্জিনিয়ারদিগের মত না নিয়া বিপ্লব করা চলিবে না। তাই নেতা কতিপয় ইঞ্জিনিয়ার ডাকিয়া পাঠাইলেন। মাথায় হেলমেট পড়িয়া সদর ভাই মাঠে মাঠে বিপ্লবের ছক কষিতে লাগিলেন। ভাবিলেন, বিপ্লবের ব্লুপ্রিন্ট রেডি হইতে চলিল। এইবার হইবেই হইবে। কিন্তু পার্টি অফিস হইতে আসিবার সময় তিনি না খাইয়া আসিয়াছিলেন, নেতা ফিরাচল তা জানিতেন তাই তিনি সদর ভায়ের জন্য টিফিন পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলেন। ফিরাচল দেখিলেন পার্টি অফিসে কোন টিফিন কেরিয়ার নাই, প্লেট-গ্লাসও দেখিলেন না। কাজের সময় কোন জিনিস যদি হাতের কাছে মেলে? ফিরাচল রাগিয়া গেলেন। তবুও টিফিন পাঠানো আবশ্যক, নেতা না খাইয়া ইঞ্জিনিয়ারদিগের সহিত গিয়াছেন। টিফিন পাঠাইতেই হইবে। ফিরাচল বুদ্ধি করিয়া বৃহদাকার একটি গামলাম দিলেন ভাত, যেহেতু নেতা না খাইয়া গেছেন তাই ভাত একটু বেশি করিয়াই দিলেন। জল নিবার জন্য যুৎসই কোন পাত্র না পাইয়া বালতিতে করিয়া দিলেন জল; জল খাইবার জন্যে দিলেন বৃহদাকার একটি কাসার গ্লাস। সব সাজাইয়া কমরেড যমিরকে কহিলেন, সদর ভাই খাইয়া যান নাই। তিনি  মাঠে ইঞ্জিনিয়ারদিগের সাথে বিপ্লবের নীল নকশা করিতেছেন তাহাকে টিফিন দিয়া আইস।
কমরেড কহিল, আচ্ছা। কমরেড ভাতের ডিশ লইল মাথায়, বাম হাতে লইল জলের বালতি আর ডান হাতে লইল গ্লাস। কমরেড কহিল, সব কিছুর মধ্যে গ্লাসটাই বেশি ভারি, পুরণো দিনের কাসার গ্লাস বলিয়া কথা।
কমরেড টিফিন লইয়া মাঠে চলিলেন। দূর হইতে ইঞ্জিনিয়ারগণ দেখিলেন কে একজন মাথায় বৃহৎ একটি ডিশ, হাতে একটি বালতি আর বিশালাকার একটি গ্লাস হাতে লইয়া আসিতেছে। তাহারা ভাবিলেন, এইসব নিশ্চয় দরকারী কোন জিনিস হইবে। এত বড় ইঞ্জিনিয়ার হইয়াও তাহারা এইসব দরকারী জিনিসের তাৎপর্য বুঝিলেন না তাই লজ্জা পাইয়া চুপ করিয়া রহিলেন। সদর ভাইও দেখিলেন যমির কী যেন লইয়া আসিতেছে, আসিতে আসিতে হাঁফাইয়া উঠিয়াছে। তার বুঝিতে বাকি রহিল না; কমরেড যতিন সদর ভায়ের জন্য টিফিন আনিতেছে। সদর ভাই বিব্রত হইয়া মুখ ফিরাইয়া রহিলেন, এইসব তার জন্য না হইতেও পারে। কিন্তু যতিন সোজা তার দিকেই আসিতেছে যে! নেতা লজ্জায় লাল হইয়া উঠিলেন। তিনি দ্রুত আর একটা স্পটে চলিয়া গেলেন। যতিন সে দিকেও যাইতে লাগিল। নেতা আবার সরিয়া গেলেন। যতিন পিছ্ ছাড়িবার পাত্র নহে, সেও নেতাকে অনুসরণ করিল। ইঞ্জিনিয়ারগণ প্রথমে কিছুই বুঝিতে পারেন নাই, আবার অজ্ঞতা প্রকাশ হইয়া পড়ে এই ভয়ে মুখ খুলিতেও পারিতেছেন না। যখন তাহারা বুঝিল যে নেতার জন্যে টিফিন আসিয়াছে তখন তাহারা মুখ চিপিয়া হাসিতে লাগিলেন। দু একজন মুখ ঘুরাইয়া মাটি আর আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। যতিন আগাইয়া আসিতেছে দেখিয়া সদর ভাই কড়া দৃষ্টিতে চাহিলেন; যতিন ভাবিল, টিফিন আনিতে দেরি হইয়াছে তাই নেতা রাগ করিয়াছেন। তাই সে দৌড়াইয়া আসিতে লাগিল। কী করিতে হইবে না বুঝিয়া সদর ভাই দৌড়াইয়া পালাইতে লাগিলেন। যতিনও পেছনে পেছনে দৌড়াইল,কহিল, সদর ভাই, আপনার টিফিন। সদর ভাই, আপনার টিফিন লইয়া আসিয়াছি, সদর ভাই। যতিন যুবক, তাহার সাথে সদর ভাই পারিবে কেন? যতিন তাহাকে ধরিয়া ফেলিল, কহিল, সদর ভাই, আপনার টিফিন আনিয়াছি। এত ভারি গ্লাস দিয়াছে ফিরাচল যে হাত ব্যাথা করিতেছে।
আমি খাইব না। কহিলেন নেতা।
: আপনি খাইয়া আসেন নাই, ফিরাচল ভাই পাঠাইয়া দিল, না খাইলে অসুখ করিবে।
সদর ভাই রাগিয়া উঠলেন, তাহাদের উচ্চকণ্ঠ শুনিয়া ইঞ্জিনিয়ারগণ আগাইয়া আসিলেন। তাহাদের একজন কহিলেন, খাইয়া নিন সদর ভাই, কষ্ট করিয়া আনিয়াছে।
: ভাগিয়া যাও কহিলাম।
: রাগ করিবেন না সদর ভাই, কমরেড কষ্ট করিয়া আনিয়াছে। অন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার কহিল, খাইয়া নিন আনিয়াছে যখন।
সদর ভাই দেখিলেন, বেশি রাগ করিলে ভাল দেখাইবে না তাছাড়া এই ঘটনা ইতিহাসে কীভাবে লিখিত হইবে তারই বা নিশ্চয়তা কী; তাই হাত ধুইয়া খাইতে বসিলেন। ইঞ্জিনিয়ারদিগের কী হইল তাহারা আড়ালে গিয়া হাসিতে লাগিল। তাহারা বুঝি টিফিন খায় না? সদর ভাই খাইলেই  দোষ?
পার্টি অফিসে আসিয়া সদর ভাই লাঠি লইয়া সকলকে মারিতে লাগিলেন, তিনি খাইয়া যান নাই বলিয়া টিফিন পাঠাইতে হইবে? দিনটা কমরেডদিগের ভাল যায় নাই, ভাগ্য ভাল লেখক সেই দিন অফিসে ছিলেন না। শুনিয়াছি সদর ভাই-এর ক্রোধ হইতে কেহ রেহাই পায় নাই, লাঠি লইয়া তিনি যাকে সামনে পাইয়াছে তাকেই মারিয়াছেন। টিফিন পাঠাইবার জন্য এর আগে কেহ মার খাইয়াছে বলিয়া শুনি নাই। সবচেয়ে বেশি মার খাইল ফিরাচল। কারণ টিফিন সেই পাঠাইয়াছিল। তাহারই বা কী দোষ, নেতা খাইয়া মাঠে যান নাই তাই সে বুদ্ধি করিয়া টিফিন পাঠাইয়াছিল; তবু রহস্য রহিল, সেদিন আসলে পার্টি অফিসে কী ঘটিয়াছিল। এসব বৃত্তান্ত আর বাড়াইতে ইচ্ছা করি না, সাক্ষিরা এখনো বাঁচিয়া আছেন। শুনিয়াছি বৃহদাকার দুঃখ পাইলে আকাশের দিকে চাহিয়া মহাকালের উদ্দেশ্যে অভিযোগ করিতে হয়, ইহাতে মহাকাল উত্তর দিলেও দিতে পারে। কেহ কেহ উত্তর পাইয়াছে শোনা যায়। ফিরাচলও বোধ করি তা জানিত, সে অফিসের ছাদে উঠিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া কহিল, আমার কী দোষ? কেন মার খাইলাম!
আমরাও বলি, ফিরাচলের কী দোষ? কেন সে মার খাইল? কী দোষ সে করিয়াছিল-ভাত না হয় একটু বেশিই দিয়াছিল। অন্ধকূপ হত্যা, আলেকজা-ারের মৃত্যু, চেঙ্গিস খানের মৃত্যু, হিটলারের মৃত্যু আরও কত সমস্যার সমাধান ইতিহাস করিতে পারিল না; সদর ভাইও ঐতিহাসিকদিগের কাজ বাড়াইয়া দিলেন। 
সদর ভাই ভাবিলেন, অনেক দিন ধরিয়া এই পার্টি গড়িয়া তুলিয়াছি, অনেক রক্ত ঝড়িয়াছে, পার্টি ছাড়িলে কী করিয়া খাইব? পথে গিয়া দাঁড়াইতে হইবে।  পার্টি কে গড়িয়াছি, অনেক রক্ত ঝড়িয়াছে, পার্টি ছাড়িলে কী করিয়া খাইব? পথে গিয়া দাঁড়াইতে হইবে। কে ইহার পরিচর্যা করিয়াছে? তা হইলে কেন পার্টি ছাড়িব? আমেরিকা, ইউরোপ ভ্রমণের কথা স্মরণ করিলেন, এবং রোমাঞ্চিত হইলেন। পার্টি ছাড়িলে আর কি পারিব ওইসব বুর্জোয়া দেশ ভ্রমণ করিতে? বুর্জোয়াগণের ষঢ়যন্ত্র বুঝিতে মাঝে মাঝে ভ্রমণ আবশ্যক। নেতা প্রতীক্ষা করিলেন কিন্তু কেহ তাহাকে ডাকিয়া আনিল না অগত্যা স্বয়ং কাহারো প্রতীক্ষা না করিয়া সদর্পে আসিয়া হাজির হইলেন এবং বিতর্কের উষ্ণতা বাড়াইয়া দিলেন। তথাপি সেই তাপে ব্যাকটেরিয়াসমূহ ক্লান্ত হইলেও ভাইরাস সমূহ গ্রাহ্য করিল না।
সদর ভাই-এর অমর কাহিনি’র অংশ বিশেষ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন